সৃজনশীল সাংস্কৃতিক সংগঠন হিসেবে ‘শিল্পকলা পদক’-২০২০ পেয়েছে দিনাজপুরের ঐতিহ্যবাহী শতবর্ষী প্রাচীন নাট্য প্রতিষ্ঠান দিনাজপুর নাট্য সমিতি। এছাড়া দেশের শিল্প-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে জাতীয় পর্যায়ে বিশেষ অবদানের জন্য বাংলাদেশ শিল্পকলা অ্যাকাডেমির উদ্যোগে ১৮ গুনী ও ২ সংগঠনকে ‘শিল্পকলা পদক ২০১৯ ও ২০২০’ প্রদান করা হয়।
গত ২২ সেপ্টেম্বর ঢাকায় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালা মিলানয়তনে এই পদক প্রদান করা হয়। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে ভার্চুয়ালি উপস্থিত ছিলেন রাষ্ট্রপতি জনাব মো. আবদুল হামিদ। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, এমপি এবং সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আবুল মনসুর। সভাপতিত্ব করেন সংস্কৃতিবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী কে.এম খালিদ এবং স্বাগত বক্তব্য প্রদান করেন অ্যাকাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী।
অনুষ্ঠানে সভাপতি সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ এর হাত হতে দিনাজপুর নাট্য সমিতিকে দেয়া পদক গ্রহন করেন নাট্য সমিতির সভাপতি চিত্ত ঘোষ।
উল্লেখ্য, দেশের শিল্প-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে জাতীয় পর্যায়ে বিশেষ অবদানের জন্য গুণীজনদের অবদানকে সম্মান ও স্বীকৃতি জানাতে বাংলাদেশ শিল্পকলা অ্যাকাডেমির উদ্যোগে ২০১৩ সাল থেকে ‘শিল্পকলা পদক’ প্রদান করা হয়। করোনা মহামারীর কারণে ‘শিল্পকলা পদক’ এর অনুষ্ঠান স্থগিত থাকায় এ বছর ২০১৯ ও ২০২০ দু’বছর এর পদক একসঙ্গে প্রদান করা হয়। ২০১৯ সালে একটি সংগঠনসহ দশজন ও ২০২০ সালে একটি সংগঠনসহ দশজন করে মোট বিশ জনকে এ পদক প্রদান করা হয়।
উনিশ শতকের শেষ প্রান্তে মঞ্চ নাটক চর্চার প্রাণকেন্দ্র কলকাতার ঢেউ দিনাজপুরকেও আন্দোলিত করে। ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দের ৭ ডিসেম্বর প্রথম নাটক ‘জয়দ্রথ’ অভিনীত হয় দিনাজপুরের রথের মাঠে। ১৮৮৫ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে দিনাজপুরে ‘ডায়মন্ড জুবিলী থিয়েটার’ কোম্পানি গঠিত হয়। ১৯০৪ সালে দিনাজপুর শহরের মধ্যস্থলে ক্ষেত্রীপাড়ায় প্রধানত দিনাজপুরের নাট্য আন্দোলনের অগ্রদূত বিশিষ্ট মঞ্চাভিনেতা ও নাট্যকার শ্রী হরিচরণ সেনের উদ্যোগে ‘ডায়মন্ড জুবিলী থিয়েটার’ হল স্থাপিত হয়। পরবর্তীকালে প্রাইভেট থিয়েটার রূপান্তরিত হয় শৌখিন নাট্যচর্চায়। কিন্তু এটির স্থায়িত্ব বেশি দিন হয়নি। এটি চলাকালে নাট্যমোদিদের মতের অমিল ঘটে এবং ১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দের ২১ জুন প্রায় ২৬ দশমিক ২৫ শতাংশ ভুমির উপর স্থাপিত হয় ‘ দিনাজপুর নাট্য সমিতি ‘।
অবিভক্ত দিনাজপুর জেলার বালিয়াডাঙ্গী থানার শাহবাজপুর গ্রামের নিবাসী শ্রীযুক্ত বসন্ত কুমার দাস-এর দুই পুত্র শ্রীযুক্ত ভবানী কুমার দাস ও শ্রীযুক্ত শিশির কুমার দাস এবং এক কন্যা শ্রীমতি কাঞ্চন মনি চৌধুরানী (স্বামী শ্রীযুক্ত পতিমাধব চৌধুরী, সাকিনÑ মুকুরিয়া, ডাকঘরÑ বারসঁই ঘাট, জেলা পূর্ণীয়া,বিহার।) তাঁদের নামীয় ওই পরিমান ভুমি দিনাজপুর নাট্য সমিতি’র নামে দান করেন।
দিনাজপুর নাট্য সমিতির প্রধান পৃষ্ঠপোষকতা করেন গুদড়ীবাজারের (বর্তমানে চকবাজার নামে পরিচিত) নাট্যপ্রিয় জমিদার রাধা গোবিন্দ রায় চৌধুরী। এ ছাড়াও এর প্রতিষ্ঠায় ভূপাল চন্দ্র সেনেরও অগ্রণী ভূমিকা ছিল। দিনাজপুরের মহারাজা জগদীশ নাথ রায়, ডাক্তার যামিনী সেন, নিশিকান্ত রায় চৌধুরী, গিরিজা মোহন নিয়োগী, মীর হামাত হোসেন প্রমুখের সহযোগিতায় ‘চন্দ্রগুপ্ত’ নাটকের মঞ্চায়নের মাধ্যমে দিনাজপুর নাট্য সমিতির প্রথম যাত্রা শুরু হয়। কুলোদ বাবু, কুনুবাবু, বিভূতি চাঁদ, হিরণ¥য় বাবু প্রমুখ সে সময় দিনাজপুর নাট্য সমিতি প্রযোজিত বিভিন্ন নাটকে স্ত্রী চরিত্রে অভিনয় করে নাট্যাঙ্গনে বেশ সুনাম অর্জন করেন।
বিশের দশকে নাট্য সমিতির গুণগত পরিবর্তন ঘটতে শুরু করে। তখন থেকে দিনাজপুর নাট্য সমিতি বিত্তবানদের অনুদান ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে এবং ক্রমশ দর্শকবৃন্দের ওপর নির্ভরশীল হয়ে ওঠে। এ সময় হতে পৃষ্ঠপোষকদের ভূমিকায় জমিদার শ্রেণির উপস্থিতি ধীরে ধীরে লুপ্ত এবং পাশাপাশি নাটকের টিকিট বিক্রি শুরু হয়। একই সময়ে দিনাজপুর নাট্য সমিতি মঞ্চে প্রফুল্ল, রাজা হরিশ চন্দ্র, শাহজাহান, মহারাজা নন্দ কুমার, শ্রী দূর্গা, কর্ণাজ্জুন, রানা প্রতাপাদিত্য, কেদার রায়, আলমগীর, ফুল্লরা, মণীষা, প্রফুল্ল প্রভৃতি সামাজিক, পৌরাণিক ও ঐতিহাসিক নাটকের অনুপ্রবেশ ঘটে। কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, সাহিত্যিক তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়, নাট্য ব্যক্তিত্ব মন্মথ রায়, চলচ্চিত্রকার রাজেন তরফদার, নটরাজ শিব প্রসাদ কর, জাদু সম্রাট পি.সি. সরকার (প্রতুল চন্দ্র সরকার), জনপ্রিয় চিত্রনায়ক রহমান, সুভাষ দত্ত (পটলা) সহ নাট্যকারদের স্মৃতিধন্য এই নাট্য সমিতি।
দিনাজপুরে নাট্য আন্দোলনের গুণিজনদের অন্যতম ছিলেন দিনাজপুর রঙ্গমঞ্চের প্রবাদ পুরুষ শিব প্রসাদ কর ও দিনাজপুর নাট্যাভিনয়ের জনক হরি চরণ সেন। ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দে তারাশংকরের ‘দুই পুরুষ’ উপন্যাসের নাট্যরূপ দেন শিবপ্রসাদ কর। ‘দুই পুরুষ’ নাটকটির আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে দিনাজপুরের নাট্য সমিতিতে নাটক দেখতে আসেন সাহিত্যিক ও উপন্যাসিক তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়। রঙ্গমঞ্চ ও নাট্য পরিচালনার কর্ণধার ছিলেন শিব প্রসাদ কর। দিনাজপুরে নাট্য অভিনয়ের সাথে একটানা ৩৫ বছর নাট্য সমিতি মঞ্চে সুদক্ষ সারথীর ভূমিকায় তাঁর নিরলস অবদান ছিল দু’যুগেরও বেশি। নাট্য সমিতির সমৃদ্ধির যুগে ১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত নাট্য সমিতির মঞ্চায়িত নাটকের মধ্যে মন্যু রায়ের চাঁদ সওদাগর, সীতা, সাবিত্রী ও খনা নাটক এবং শরৎচন্ত্রের উপন্যাস অবলম্বনে নাট্য রূপায়িত বৈকুন্ঠের উইল, মহেষ, রামের সুমতি ছাড়াও পৌরাণিক নাটক স্বর্ণলতা, ঐতিাসিক নাটক রানা রনজিৎ সিংহ, সিরাজ উদ্দৌলা, টিপু সুলতান, শাহজাহান, আলমগীর, হায়দার আলী নিয়মিতভাবে দিনাজপুর নাট্য সমিতি মঞ্চে সাফল্যের সঙ্গে মঞ্চস্থ হয়েছে।
১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে দেশ বিভাগের পর পাঁচ বছর দিনাজপুর নাট্য সমিতি নিষ্প্রভ থাকে। এর পরবর্তী সময়ে নাট্য সমিতিতে একে একে অভিনীত হয়েছে ঐতিহাসিক নাটক মিশর কুমারী, মীর কাশিম (মনাথ রায়), সিরাজ উদ্দৌলা (শচীন্দ্রনাথ সেন গুপ্ত), টিপু সুলতান (মহেন্দ্রগুপ্ত), শাহজাহান (দ্বিজেন্দ্র লাল রায়), সামাজিক নাটক কালিন্দী (তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়), মাটির ঘর (বিধায়ক ভট্টাচার্য), দুই পুরুষ (তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়) এবং হাস্যরসাত্মক নাটক ‘তাইতো’ প্রভৃতি। ১৯০৪ খ্রিষ্টাব্দে সম্ভবত দিনাজপুর নাট্য সমিতি প্রযোজিত এবং আলী মনসুর রচিত ‘পোড়াবাড়ী’ নাটকটিতে প্রথম মুসলিম মহিলা শিল্পীর আবির্ভাব ঘটে। এ ছাড়া প্রখ্যাত অনুষ্ঠান সংগঠক শ্যামা ব্যানার্জির তত্ত্বাবধানে শ্যামলী নাটকটি অভিনীত হয় যেখানে কেবল মাত্র মহিলা শিল্পীগণ সকল নাট্য চরিত্রে অভিনয় করেন।
ষাটের দশকে নাট্য সমিতি মঞ্চে অভিনীত নাটকের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো কলির জীন (তাজ মিলুর রহমান, ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দ), এরাও মানুষ (সন্তোষ সেন, ১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দ) কাঞ্চন রঙ্গ (শম্ভু মিত্র ও অমৃত মৈত্র, ১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দ) বৌদির বিয়ে, লবণাক্ত, মরাস্রোত, কুহকিনী, ফিংগার প্রিন্ট ইত্যাদি।
১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে দিনাজপুর নাট্য সমিতি প্রতি বছর আন্তঃজেলা নাট্যোৎসব ও অভিনয় প্রতিযোগিতা শুরু করে। এই নাট্যোৎসব থেকে সমিতি নিয়মিত দর্শনীর বিনিময়ে নাটক মঞ্চস্থ করে আসছে। এর ফলে নতুন নাট্য গোষ্ঠীর সৃষ্টি, নাট্যচর্চার গতিশীলতা বৃদ্ধি এবং বিভিন্ন নাট্য গোষ্ঠীর মধ্যে ভাবের আদান প্রদানের মাধ্যমে নাট্যচর্চার মান উন্নয়নের ক্ষেত্রে এই প্রতিযোগিতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে নাট্য সমিতিতে প্রচুর নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে। ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে দিনাজপুর নাট্য সমিতি ময়মনসিংহ আন্তঃজেলা নাট্যোৎসবে ‘ভূমিকম্পের পরে’ নাটকটি মঞ্চায়নের মাধ্যমে প্রতিযোগিতায় ঘোষিত ১১ টির মধ্যে ৯টি পুরস্কার লাভ করে। ভূমিকম্পের আগে, বাকী ইতিহাস, অমৃতস্য পুত্র, এই দশকের মঞ্চে, সম্রাট, ভূমিকম্পের পরে, সুবচন নির্বাসনে, উল্কা, ভেঁপুতে বেহাগ, ফিংগার প্রিন্ট, অন্ধকারের নীচে সূর্য, ভাড়াটে চাই, ক্যাপ্টেন হুররা, আলিবাবা, কুহকিনী, সেনাপতি, যদিও সন্ধ্যা, নতুন মানুষ, ক্ষত বিক্ষত, পাহাড়ী ফুল, তৃতীয় পুরুষ, এখনও ক্রীতদাস, তোমরাই, দ্যাশের মানুষ, হিসাবের খাতা, দেওয়ান গাজীর কিসসা, মাগানা সওয়ারী, কেনা রাম বেচারাম, একাত্তরের পালা, এই রোদ এই বৃষ্টি, মানুষ, নৈশ ভোজ, স্পধা, ঝিঁঝিঁ পোকার কান্না, হত্যারে প্রভৃতি আরো অনেক নাটক।
পরবর্তী সময়ে সংস্থাটির আত্মবিকাশ ও উন্নতি সাধনের ভূমিকায় যাদের সহযোগিতা অবিচ্ছিন্ন তারা হলেন- কাজী বোরহান, মকবুল মোক্তার (প্রয়াত), গুরুদাশ তালুকদার (প্রয়াত), আদল সরকার (প্রয়াত), ডা. হাফিজ উদ্দীন (প্রয়াত), নিত্য গোপাল, কমলেশ দা (প্রয়াত), মনুদা (প্রয়াত), তালেব ভাই (প্রয়াত), আকবর আলী ঝুনু (প্রয়াত), শাহ রহমত বাবু ভাই (প্রয়াত), মির্জা আনোয়ারুল ইসলাম তানু (প্রয়াত), মোহন কুমার দাশ (প্রয়াত) প্রমুখ।
২০১৩ খ্রিষ্টাব্দের দিনাজপুর নাট্য সমিতির শতবর্ষ পূর্তি হয়েছে। ২০১৫ খ্রিস্টাব্দের ২৯ অক্টোবর থেকে ২১ নভেম্বর পর্যন্ত নাট্য সমিতির একবিংশ নাট্যোৎসব শুরু হয়েছিল। নাট্য সমিতি যামিনীর শেষ সংলাপ নাটকটির মধ্যদিয়ে নাটকের শতবর্ষ পূর্তি ও একবিংশ দিনাজপুর নাট্যোৎসব শুরু করেছিল। এরপর ’আতর আলীর নীলাভ পাট’, ’সাদা কাগজ’ ’কনক সরোজিনী’ ‘নন্দিনীর পালা’ সহ ১০টি নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে শতাধিক বর্ষী প্রাচীন দিনাজপুর নাট্য সমিতির মঞ্চে।