দিনাজপুর নাট্য সমিতির শতবর্ষপূর্তি ও নাট্যোৎসব লিফলেট
শতবর্ষের ঐতিহ্যে দিনাজপুর নাট্য সমিতি
দিনাজপুর নাট্য সমিতি ১৯১৩ খ্রি. প্রতিষ্ঠিত একটি নাট্যশালা। সে হিসেবে বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির বয়স একশত নয় বছর। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি এই প্রতিষ্ঠানকে বাংলাদেশের অন্যতম শতবর্ষী নাট্যমঞ্চ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। স্বাধীনভাবে থিয়েটার চর্চার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠানটি শতবর্ষ আগে তৎকালীন মহারাজা গিরিজানাথ রায় এর সরাসরি তত্ত্বাবধানে যাত্রা শুরু করেছিল। বাংলার বহু উল্লেখযোগ্য সাহিত্য-সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় দিনাজপুর নাট্যসমিতির এই দীর্ঘ যাত্রাপথে বিভিন্নভাবে বিভিন্ন মাত্রায় সংযুক্ত হয়েছিলেন এই প্রতিষ্ঠানের সাথে। বিশেষ করে নাট্যকার মন্মথ রায়, বিপিন চন্দ্র পাল, মুকুন্দ দাস, পি.সি সরকার, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়, কুমার রায়, শিবপ্রসাদ কর, এম.আর আক্তার মুকুল, নিতুন কুন্ডু, সুভাষ দত্ত, রাজেন তরফদার, রামেন্দ্র মজুমদার, আবদুল্লাহ আল মামুন, কামাল লোহানী, সৈয়দ হাসান ইমাম, আলী যাকের, সারা যাকের, মামুনুর রশিদ, আসাদুজ্জামান নূর, ড. গওহর রিজভী, শ্যামল সেন গুপ্ত, চন্দন সেন, মো: লিয়াকত আলী লাকী প্রমুখ উজ্জ্বলতম ব্যক্তিত্বের স্পর্শে ধন্য হয়েছে দিনাজপুর নাট্য সমিতি শতবর্ষ জুড়ে।
১৯১৩ খ্রি. ডায়মন্ড জুবিলি থিয়েটারের শিল্পীদের মতবিরোধকে কেন্দ্র করে প্রায় রাতারাতি গোলকুঠি বাহাদুর বাজার এলাকায় গড়ে ওঠে একটি নতুন নাট্যশালা- ‘দিনাজপুর ড্রামাটিক হল‘। যাদের সক্রিয় উদ্যোগে এই নাট্যশালাটি প্রতিষ্ঠা পায় তারা হলেন নিশিকান্ত চৌধুরী, ভূপাল চন্দ্র সেনগুপ্ত, গিরিজামোহন নিয়োগী, ভবানী প্রসাদ চৌধুরী, ট্যাঙ্গর চক্রবর্তী, শিশির প্রসাদ চৌধুরী, নেদাবাবু, গৌরপ্রসাদ বড়াল, শরৎচন্দ্র গুপ্ত, চারুচন্দ্র সেন, অবনী নন্দী, দুখু সেন, হরিনারায়ণ চক্রবর্তী এবং আরও অনেক নেতৃস্থানীয় শিল্পী। দিনাজপুর ড্রামাটিক হল নির্মাণের জন্য ২৬.২৫ শতক জমি দান করেন শ্রীযুক্ত ভবানী কুমার দাস, শ্রীযুক্ত শিশির কুমার দাস, শ্রীমতি কাঞ্চন মনি চৌধুরাণী।
ঐ বছর ২১ জুন, রবিবার নবনির্মিত ড্রামাটিক হল নাট্যশালার দ্বারোদঘাটন করেন জেলা কালেক্টর মি. হ্যারউড। উদ্বোধনী নাটক ছিল ভূপাল সেনগুপ্ত এর পরিচালনায় ‘চন্দ্রগুপ্ত’। ১৯১৩ থেকে ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে যে সকল নাটক সাফল্যের সাথে মঞ্চস্থ হয় তার মধ্যে ‘চন্দ্রগুপ্ত’, ‘আবু হোসেন’, ‘হরিশচন্দ্র’, ‘জয়দ্রথ’, ‘প্রফুল্ল’, ‘কর্ণার্জুন’, ‘শ্রীকৃষ্ণ’, ‘উত্তরা’, ‘ফুল্লরা’, ‘সীতা’, ‘সিন্ধুবিজয়’, ‘কিন্নরি’, ‘দেবলা-দেবী’, ‘পরদেশী’, ‘শ্রীদুর্গা’, ‘বিত্রাসুর’, ‘চাঁদ সওদাগর’, ‘স্বর্ণলঙ্কা’ উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও কার্তিক গুপ্তের ‘চাণক্য’, দুখু সেনের ‘গোলাম হোসেন’, কামাখ্যানিয়োগীর ‘দিলদার’, রামাপদ দাশগুপ্তর ‘ঔরঙ্গজেব’, শচীন বোসের ‘সাজাহান’, রাধিকারমণ ভট্টাচার্যের ‘সত্যবান’ চরিত্রের অভিনয় স্মরণীয় হয়ে আছে।
দিনাজপুর নাট্য সমিতির উজ্জ্বলতম জ্যোতিষ্ক শিবপ্রসাদ কর ১৯১৪ খ্রি. ‘চাঁদ বিবি’ নাটকে একটি নারী চরিত্রে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে নাট্যমঞ্চে তাঁর আবির্ভাব ঘটে। পরবর্তীতে আরো কিছু নারী চরিত্রে অভিনয় করে ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের পর তাঁর নাট্যাঙ্গনে সৃজনশীলতার পূর্ণাঙ্গ বিকাশ ঘটে। তাঁর লেখা ‘স্বর্ণলঙ্কা’ নাটকটি মঞ্চস্থ হয় নাট্য সমিতি মঞ্চে। এরপর নাটকটি কলকাতাসহ ভারতের বিভিন্ন মঞ্চে সফলতার সাথে মঞ্চস্থ হয়। ১৯২৫ থেকে ১৯৩৫ খ্রি. মধ্যে নাট্য সমিতি মঞ্চে মঞ্চস্থ উল্লেখযোগ্য নাটকগুলো হলো ‘প্রতাপাদিত্য, ‘সাজাহান’, ‘সুলতান’, ‘পলাশীর পরে’, ‘মিশর কুমারী’, ‘দেবী চৌধুরানী’, ‘রণজিৎ সিঙ’, ‘রাজা নন্দকুমার’, ‘হায়দার আলী’, ‘টিপু সুলতান’, ‘কেদার রায়’, ‘আলমগীর’। শিবপ্রসাদ কর অসাধারণ নৈপুণ্য প্রদর্শন করেন এ সকল নাটকে অভিনয় করে। শিবু করের ‘দুই পুরুষ’ নাটকে নটু বিহারী চরিত্রে দু’রাত্রিতে দুইমাত্রার অভিনয় স্বয়ং বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক তারাশংকরকেও অভিভূত করে। শিবপ্রসাদ কর তাই দিনাজপুরের নাট্যোমোদীদের কাছে মিথ হয়ে আছেন। এই সময়ে শিব প্রসাদ করের সাথে যাঁরা মঞ্চে কৃতিত্বের সাথে অভিনয় করেছিলেন তাঁদের মধ্যে শ্রীশচন্দ্র গুপ্ত (টুনু), সুধীর চন্দ্র রায়, কালিয়া কান্ত রায়, ক্ষিতিশচন্দ্র দাশগুপ্ত, নারায়ণবন্ধু সরকার, রমাপতি বাবু, হিরন্ময় বাবু, বিভূতি চাঁদ প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। বিশের দশক থেকে নাটকে যোগ দেন সতীশচন্দ্র গুপ্ত, মণি সেন, তুলসী চাঁদ, ধীরেন্দ্র নারায়ণ ঘোষ, জিতেন মজুমদার, গুরুদাস তালুকদার, কেষ্ট নন্দী, রতন মাষ্টার, রাধিকা আইচ, সত্যপদ রায়, মনু দাশগুপ্ত, বিমল দাশগুপ্ত, অরণেন্দু নন্দী, কামাক্ষ্যা চ্যাটার্জী, হিরন্ময় ভট্টাচার্য, সুশীল সেন, মন্মথ দত্ত, অমিয় সেন, সতীশ চন্দ্র গুপ্ত প্রমুখ।
১৯৩৫ থেকে ১৯৪২ সালের মধ্যে দিনাজপুর নাট্য সমিতির মঞ্চে শুরু হয় সামাজিক নাটকের চর্চা। এ সময়ে যে সকল নাটক মঞ্চে আসে তারমধ্যে ‘বৈকুন্ঠের উইল’, ‘গোড়ায় গলদ’, ‘জনা’, ‘বিষবৃক্ষ’, ‘চির কুমার সভা’, ‘শেষ রক্ষা’, ‘পথের শেষে’, ‘দুই মানুষ’, ‘রামের সুমতি’, ‘পতিব্রতা’, ‘সাবিত্রী’, ‘ক্ষণা’ উল্লেখযোগ্য।
১৯৪২ খ্রি. পরবর্তী ভারত বিভক্তি পূর্বকাল পর্যন্ত ভারত বর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলন, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা মোকাবেলার জন্য দেশপ্রেম মূলক নাট্যচর্চার জোয়ার আসে। এ সময়ের উল্লেখযোগ্য নাটকগুলি হলো ‘বঙ্গে বর্গী’, ‘সিরাজদৌলা’, ‘নীল দর্পণ’, ‘মীর কাশিম’, ‘কারাগার’, ‘নতুন প্রভাত’, ‘কালিন্দী, ‘আলী বাবা’। ‘সিরাজদ্দৌল্লা’ চরিত্রে সতীশচন্দ্রের অভিনয় উচ্চ প্রশংসিত হয়েছিল। উল্লেখ্য যে, কিছু নতুন নাট্যপ্রতিভা এ সময় সংযুক্ত হন নাট্য সমিতির সাথে। তাদের মধ্যে প্রভাত দাশগুপ্ত (ফটিক), রাজেন তরফদার, অনাদি রায়, সুতান সরকার, সুভাষ দত্ত (পটলা) প্রমুখ।
এরপর ভারত বিভক্তির কারণে নাট্যসমিতির অভিনেতা নির্দেশক ও পৃষ্ঠপোষকদের একটা বড় অংশ ভারতে চলে যায়, ফলে অল্পদিনের জন্য নাট্য সমিতি যেন কিছুটা থমকে যায়। কিন্তু ১৯৫১-৫২ ভাষা আন্দোলন কেন্দ্রিক বাঙালির নবচেতনার উন্মেষ ঘটলে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত যেসব নাটক মঞ্চস্থ হয়, এর মধ্যে অভিনয় নয়’, ‘তাই তো’, ‘তেরোশো পঞ্চাশ’, ‘নবান্ন’, ‘মাটির মায়ানগাল শিখা’, ‘দুখীর ইমান’, ‘লবনাক্ত’, ‘কাঞ্চন রঙ্গ’, ‘বাস্তুভিটা তার’, ‘মানময়ী গার্লস স্কুল’, ‘সামন্তক মনি’, ‘দ্বীপান্তর’, ‘জীবন নাটক’, ‘উল্কা’, ‘কালের পদধ্বনি’, ‘ক্ষুধা’, ‘এরাও মানুষ’ উল্লেখযোগ্য। এ সময় নারী চরিত্রে অভিনেত্রী পাওয়া দুষ্কর ছিল তাই এই সংকট মেটাতে গুরুদাস তালুকদার, তালেব আলী, গৌরাঙ্গ বারুই, সত্যেন চক্রবর্তী, নারী চরিত্রে অভিনয় করেছেন।
ষাটের দশকের মধ্যবর্তী সময় থেকে নাট্য সমিতির সাথে সংযুক্ত হয় আরো কিছু নতুন মুখ নতুন প্রতিভা। এদের মধ্যে ডা. হাফিজ উদ্দিন, নিত্য গোপাল দাস, মকবুল হোসেন (মোক্তার), কাজী বোরহান, মির্জা আনোয়ারুল ইসলাম তানু, মতিয়ার রহমান সরকার, গুরুদাস তালুকদার, আদল সরকার, আব্দুস সাত্তার, কমলেশ ঘোষ, তালেব আলী, আকবর আলী ঝুনু প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। দিনাজপুর নাট্য সমিতি তৎকালীন সময়ে কলকাতার নবনাট্য আন্দোলনের সাথে সরাসরি যুক্ত ছিল। স্বাধীনতার পূর্ব পর্যন্ত প্রতি শনিবার সাপ্তাহিক ছুটির আগের দিন নিয়মিত নাট্য মঞ্চায়নের ঐতিহ্য ছিল দিনাজপুর নাট্য সমিতির। প্রায় প্রতিষ্ঠাকালীন সময় হতেই টিকিটের বিনিময়ে নাটক প্রদর্শনীর ঐতিহ্য অব্যাহত রেখেছে দিনাজপুর নাট্য সমিতি।
১৯৬৩ খ্রি. দিনাজপুর নাট্য সমিতির জন্য অত্যন্ত গৌরবের বছর। কেননা ঐ বছর তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানে প্রথম মাসব্যাপী নাট্যোৎসব ও প্রতিযোগিতার আয়োজন করে দিনাজপুর নাট্য সমিতি যা বাঙালি নাট্যচর্চার একটি মাইলফলক হিসেবে ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে। এরপর মহান মুক্তিযুদ্ধের কারণে দিনাজপুর নাট্য সমিতির কর্মকাণ্ড বন্ধ থাকে। এ সময় অভিনেতা, নাট্যকার, নির্দেশক প্রায় সকলেই মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ে। সারাদেশের মতো নাট্য সমিতিকেও পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী জ্বালিয়ে দেয়। ফলে নাট্য সমিতির গুরুত্বপূর্ণ দলিল, নথি- কাগজপত্র ও নাটকের সেট-প্রপস পুড়ে যায়। তাই নাট্য সমিতির পূর্বের কোনো ঐতিহাসিক দলিল ও নিদর্শন খুঁজে পাওয়া যায় না। এমতাবস্থায় মুক্তিযুদ্ধোত্তরকালে পুনরায় শক্ত হাতে হাল ধরে নাট্য সমিতিকে পুনর্গঠন করেন কাজী বোরহান, মির্জা আনোয়ারুল ইসলাম তানু, আব্দুস সাত্তার, সরদার মোশাররফ হোসেন, শাজাহান শাহ, আদল সরকার, সফি মকসুদ নূরু প্রমুখ। তারা নাট্য সমিতির অবকাঠামো উন্নয়নসহ নাটক মঞ্চায়নে বড় ভূমিকা রাখেন। আবারও শুরু হয় নাটক মঞ্চায়ন ও মাসব্যাপী নাট্যোৎসব ও প্রতিযোগিতা।
১৯৭১ থেকে ২০০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে যে নাটকগুলো মঞ্চস্থ হয় তার মধ্যে ‘কিংশুক যে মরুতে’, ‘সম্রাট’, ‘ভেঁপুতে বেহাগ’ ‘অন্ধকারের আয়না’, ‘ইতিহাস কাঁদে’, ‘ভূমিকম্পের আগে’, ‘দুই বোন’, ‘ফিঙ্গার প্রিন্ট’, ‘দেওয়ান গাজীর কিস্সা’, ‘ভূমিকম্পের পরে’, ‘বাকি ইতিহাস’, ‘সেনাপতি’, ‘ক্যাপ্টেন হুররা’, ‘যদিও সন্ধ্যা’, ‘ত্রিরত্ন’, ‘দ্যাশের মানুষ’, ‘ক্ষত বিক্ষত’, ‘এখনো ক্রীতদাস’, ‘পাথর’, ‘সাজানো বাগান’, ‘চোখে আঙ্গুল দাদা’ উল্লেখযোগ্য।
১৯৭৩ খ্রি. ময়মনসিংহ আন্তজেলা নাট্যোৎসবে কাজী বোরহান পরিচালিত ‘ভূমিকম্পের পরে’ নাটকটি ১১টির মধ্যে ৯টি পুরস্কার অর্জন করে। ১৯৭৬ খ্রি. বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি আয়োজিত জাতীয় নাট্যোৎসবে কাজী বোরহান পরিচালিত ও অভিনীত ‘ক্যাপ্টেন হুররা’ নাটকটি ‘এ’ ক্যাটাগরি মর্যাদা লাভ করে।
এসময় নাট্য সমিতির মঞ্চে নারী চরিত্রে অভিনয় করার জন্য বেশ কিছু নারী এগিয়ে আসেন। তাদের মধ্যে রেনু সরকার, ময়না নন্দী, মালা সরকার, জয়ন্তী সরকার, শিখা ঘোষ, সন্ধ্যা দাস, সাবেত্রী রায়, আজিজা খানম মনি, ছায়া আকবর, সতী নন্দী উল্লেখযোগ্য।
নাট্য সমিতিতে যেন নতুন প্রাণের সঞ্চার হয়। ২০০০ খ্রি. পরবর্তী উল্লেখযোগ্য নাটকগুলো হলো ‘মানুষ’, ‘ডিম্ব কাব্য’, ‘রাজ কার্য’, ‘মেহেরজান আরেকবার’, ‘নেপেন দারোগার দায়ভার’ ‘কবর’, ‘আ-মরি বাংলা ভাষা’, ‘নতুন মানুষ’, ‘তৃতীয় পুরুষ’, ‘দর্পণ সাক্ষী’, ‘মধুরেণু’, ‘রাতের অতিথি’, ‘স্বাধীনতার সংগ্রাম’, ‘এখনও যুদ্ধ’, ‘লাল সূর্যের দেশে’, ‘ক্ষ্যাপা পাগলার প্যাচাল’, ‘হত্যারে’, ‘হত্যার শিল্পকলা’, ‘অরাজনৈতিক’, ‘দায়বদ্ধ’, ‘সুবচন নির্বাসনে’, ‘যামিনীর শেষ সংলাপ’, ‘উনিশশো একাত্তর’, ‘আতর আলীদের নীলাভ পাট’, ‘মেরাজ ফকিরের মা’, ‘শুনো হে লখিন্দর’, ‘সাদা কাগজ’, ‘কনক সরোজিনী’, ‘বীরবান্টা’, ‘হিং টিং ছট’ এবং রক্তকরবী অবলম্বনে ‘নন্দিনীর পালা’।
২০১৫ খ্রি. নাট্য সমিতির শতবর্ষপূর্তি উপলক্ষে একবিংশ নাট্যোৎসব ও প্রতিযোগিতা এবং ২০১৮ খ্রি. মাস ব্যাপী দ্বাবিংশ নাট্যোৎসব ও প্রতিযোগিতা সফলভাবে আয়োজিত ও সম্পন্ন হয়। এই উৎসবে ভারতের ৫টি ও বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা থেকে মোট ২৩টি নাটক মঞ্চস্থ হয়। উল্লেখ্য ভারতের বেশ কয়েকটি নাট্যদল অংশগ্রহণ করায় উৎসব দুটি আন্তর্জাতিক মর্যাদা লাভ করে। আজীবন কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ সে বছরই দেশের অন্যতম বিশিষ্ট নাট্যজন দিনাজপুর নাট্য সমিতির অধ্যক্ষ কাজী বোরহান বাংলাদেশ শিল্পকলা পদকে ভূষিত হন যা দিনাজপুর নাট্য সমিতির জন্য গৌরবের বিষয়।
২০১৮ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে ভারতের কলকাতায় অনীক আয়োজিত গঙ্গা-যমুনা নাট্যোৎসবে দিনাজপুর নাট্য সমিতি প্রথমবার নাটক মঞ্চয়ন করে, একই সময়ে রায়গঞ্জের সৌহার্দ নাট্যোৎসবে এবং চন্দন নগর রবীন্দ্র ভবনে মাহমুদুল ইসলাম সেলিম রচিত, নয়ন বার্টেল নির্দেশিত কনক সরোজিনী নাটকটি ব্যাপকভাবে দর্শক নন্দিত হয়। ভারতীয় বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় নাটকটির ভূয়সী প্রশংসা করা হয়। নাট্য সমিতির মর্যাদা দেশের বাহিরেও ছড়িয়ে পড়ে।
করোনাকালীন সারা দেশের সকল সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড বন্ধ হয়ে পড়ে। এ অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলে ঢাকার বাইরে নাট্যসমিতিই তার ‘স্বপ্নভঙ্গের রঙ্গমঞ্চ’ নাটকটি নিয়ে ফিরে আসে মঞ্চে। নাট্যসমিতি ‘হিং টিং ছট’ শিশুনাটক প্রযোজনার মধ্য দিয়ে শুরু করে শিশুনাট্যের নবযাত্রা। এরপর রবিঠাকুরের ‘রক্তকরবী’ অবলম্বনে সমকালীন বিশ্বের নতুনতর আর্থ-রাজনৈতিক ব্যাখ্যায় মঞ্চস্থ হয় সম্বিত সাহার রচনায় ও নির্দেশনায় ‘নন্দিনীর পালা’।
১৯১৩ থেকে ২০২২ খ্রি. পর্যন্ত পথচলার দীর্ঘ পরিক্রমায় নানান ঘাত-প্রতিঘাত, উত্থান-পতন, স্থবিরতা-গতিমানতা এসেছে; কিন্তু দিনাজপুর নাট্য সমিতি কখনোই তার নাট্যচর্চার গতিপথ থেকে বিচ্যুত হয়নি। একটি নাটকের শত মঞ্চায়ন যেমন কঠিন তার থেকে আরো অনেক বেশি কঠিন শতবর্ষজুড়ে একই আদর্শে লালিত হয়ে নাট্যচর্চার ধারাকে অব্যাহত রাখা। দিনাজপুর নাট্য সমিতি বাংলাদেশে নাট্যচর্চার ক্ষেত্রে সংস্কৃতির ইতিহাসে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবে ভূমিকা রেখেছে। এছাড়াও ভাষা আন্দালন, মহান মুক্তিযুদ্ধ ও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক আন্দোলনে সর্বদা দৃঢ় ভূমিকা পালন করেছে।
ভবিষ্যতের নাট্যচর্চাকে আরও বেগবান ও যুগপোযোগী করতে দিনাজপুর নাট্য সমিতি একটি আধুনিক নাট্য মঞ্চ নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। শিশুদের নিয়ে নাট্যচর্চার পদক্ষেপ হিসেবে নিয়মিতভাবে আয়োজন করতে যাচ্ছে শিশুনাট্যোৎসবের। আধুনিক থিয়েটারের নিয়মিত চর্চা ও অগ্রগতির লক্ষ্যে খুব শীঘ্রই নাট্যসমিতি স্বল্পমেয়াদী নাট্যপ্রশিক্ষণ কোর্স চালু করতে যাচ্ছে। বাংলাদেশের সকল জেলা শহরের নাট্যপাণ্ডুলিপি ও নাট্যনিবন্ধ সংকলন করে একটি নিয়মিত নাট্যপত্রিকা প্রকাশের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। শতবর্ষের নাট্যচর্চার স্বীকৃতি স্বরূপ নাট্যসমিতি ‘সৃজনশীল সাংস্কৃতিক সংগঠন’ হিসেবে শিল্পকলা পদক ২০২০ এ ভূষিত হয়েছে। এই স্বীকৃতি ও সম্মান শুধু নাট্যসমিতির নয় বরং আপামর দিনাজপুরের সংস্কৃতিমনস্ক জনগোষ্ঠীর তথা এদেশের সকল সাংস্কৃতিক কর্মীর।
নাট্যজগতের সুবিশাল আকাশে দিনাজপুর নাট্য সমিতি উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো তার দ্যুতি ছড়াচ্ছে। এই আলোকচ্ছটা অসীম আলোকবর্ষ পর্যন্ত এগিয়ে যাবে এই আমাদের দৃঢ় প্রত্যয়। জয় হোক নাটকের; জয় হোক নাট্য সমিতির।
শতবর্ষের ঐতিহ্যে দীপ্ত দিনাজপুর নাট্য সমিতি
শতবর্ষের ঐতিহ্যে দীপ্ত দিনাজপুর নাট্য সমিতি
প্রাচীনতম একটি সংগঠন দিনাজপুর নাট্য সমিতি ১৯১৩ সালের ২১শে জুন ‘চন্দ্রগুপ্ত’ নাটক মঞ্চায়নের মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে এবং একটি সৌখিন সংগঠন হওয়া সত্ত্বেও প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে দেশ বিভাগের পূর্ব পর্যন্ত তৎকালীন কলকাতার পেশাদার থিয়েটার অঙ্গনে অভিনীত বেশ কয়েকটি নাটকের সফল মঞ্চায়ন করে, যার প্রায় সব ক’টি দর্শক-নন্দিত হয়।
বিংশশতকের শুরুর দিক থেকে সামন্ত-সমাজের সাথে সাথে এ অঞ্চলের নাট্য-সংস্কৃতিতে জমিদার শ্রেণীর পৃষ্ঠপোষকতা ধীরে ধীরে লুপ্ত হতে থাকে। ফলে, পেশাদার থিয়েটার বিকাশের ক্ষেত্রে নানারকম অন্তরায় সৃষ্টি হয়। কিন্তু দিনাজপুর নাট্য সমিতি তখন সব ধরণের প্রতিকুলতাকে উপেক্ষা করে বহু পৌরানিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক নাটকের সফল মঞ্চায়ন করে এবং সাধারণ দর্শকের, বিশেষত মধ্যবিত্ত শ্রেনীর, পৃষ্ঠপোষকতা অর্জনের উপায় খুঁজে পেতে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৩৫ থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত নাট্য সমিতিতে নিয়মিতভাবে প্রতি শনিবার রাত দশটা থেকে রাত প্রায় তিনটা পর্যন্ত নাটক মঞ্চায়িত হত।
এ সময়কালে বাংলা সাহিত্যের অমর কথা শিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায় ও মন্মথ রায়, অভিনেতা ও আবৃত্তিকার শম্ভু মিত্র, চলচ্চিত্র নির্মাতা রাজেন তরফদার ও সুভাষ দত্ত, ভাস্কর্যশিল্পী নিতুন কুণ্ডু সহ উপমহাদেশের বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বের উপস্থিতি ও অংশগ্রহণ নাট্য সমিতিকে স্মৃতিধন্য করে রেখেছে।
কেবলমাত্র ধর্মের ভিত্তিতে ভারতবর্ষের বিভক্তি এবং রাষ্ট্রীয় প্ররোচনায় সৃষ্ট সাম্প্রদায়িক সহিংসতার কারণে ১৯৪৮ সালে সারা দেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ দলে দলে দেশত্যাগ করে। এরই অনিবার্য পরিনতিতে দিনাজপুরের বেশ কয়েকজন নেতৃস্থানীয় নাট্য সংগঠক পাড়ি জমান ভারতের পশ্চিমবঙ্গে। ফলে, দিনাজপুর নাট্য সমিতি তথা দিনাজপুরের নাট্যাঙ্গন কিছুকালের জন্য স্থবির হয়ে পড়ে। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালীর স্বাধীনতা-চিন্তার যে উন্মেষ ঘটে তার প্রভাব পড়ে বাংলার সংস্কৃতি-অঙ্গনে। নতুন করে কর্মচঞ্চল হয়ে ওঠে দিনাজপুরের নাট্যাঙ্গন। দেশ বিভাগের সময়ে এ অঞ্চলে থেকে যাওয়া বেশ কিছু হিন্দু পরিবারের পাশাপাশি অগ্রসর চিন্তার অনেক মুসলিম পরিবারের তরুণরা তখন হাল ধরে নাট্য সমিতির।
ধারণা করা হয়, প্রতিষ্ঠার পরপরই দর্শনীর বিনিময়ে নাটক প্রদর্শনের সারা শুরু করে নাট্য সমিতি। পরবর্তীতে ১৯৬৩ সালে পঞ্চাশ বছর পূর্তিতে যে উৎসব অনুষ্ঠিত হয় তাতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে প্রথমবারের মতো আয়োজন করা হয় আন্তঃজেলা নাট্য উৎসব ও অভিনয় প্রতিযোগিতা।
দিনাজপুর নাট্য সমিতির তথা দিনাজপুরের এই দুঃসাহসিক আয়োজন বাংলা নাট্যচর্চার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ মাইল ফলক হিসাবে বিবেচিত। পরপর বেশ কয়েক বছর আন্তঃজেলা নাট্য উৎসব ও অভিনয় প্রতিযোগিতা আয়োজনের ফলে উত্তর বঙ্গের অনেক জেলায়, কোথাও কোথাও মহকুমা ও থানা পর্যায়ে, নতুন নতুন নাট্য গোষ্ঠী ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের জন্ম হয় এবং বিভিন্ন এলাকার নাট্য গোষ্ঠীর মধ্যে সংস্কৃতি বিনিময়ের অবারিত সুযোগ সৃষ্টি হয়।
এইভাবে নিয়মিত বিশুদ্ধ নাট্য চর্চার পাশাপাশি মানুষের অধিকার আদায়ের স্বপক্ষে সব ধরনের কর্মকান্ড পরিচালনা করতে থাকে নাট্য সমিতি। এদেশের ভাষা-শিক্ষা-স্বাধিকার ও স্বাধীনতা আন্দোলনের বাঁকে বাঁকে মানুষকে উজ্জীবিত করার প্রয়োজনে সময়োপযোগী নাটক মঞ্চায়নের মধ্য দিয়ে উত্তরবঙ্গের তথা বাংলা নাটক ও সংস্কৃতি চর্চার অন্যতম কেন্দ্রে পরিণত হয় প্রতিষ্ঠানটি।
তাই, ১৯৭১ সালে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন এদেশের স্বাধীনতা- বিরোধী শক্তি পাকিস্তানী হানাদারদের সাথে নিয়ে গুড়িয়ে দেয় সংগঠনটির অবকাঠামো, আগুন দিয়ে পুড়ে ফেলে আসবাবপত্র দলিল সবকিছু। ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয় বাংলা নাটক ও সংস্কৃতির অন্যতম একটি নিদর্শন। কিন্তু এভাবে কি ধ্বংস করা যায় কোন জাতির আপন সংস্কৃতির ধারায় নির্মিত কোন সংগঠন?
মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা-দীপ্ত প্রজন্ম ৭১-পরবর্তীকালে নতুন করে রচনা করতে থাকে গৌরব গাঁথা। নিয়মিত নাটক মঞ্চায়নের পাশাপাশি উৎসব আয়োজন চলতে থাকে প্রতি দুই বছর অন্তর অন্তর। আমন্ত্রিত দল হিসাবে নাট্য সমিতি অংশগ্রহণ করতে থাকে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের নাট্য উৎসবে। ১৯৭৩ সালে ময়মনসিংহ আন্তঃজেলা নাট্য উৎসবে অংশগ্রহণ করলে ১১টির মধ্যে ০৯টি পুরস্কার পায় দিনাজপুর নাট্য সমিতি, সেখানে মঞ্চস্থ করে নাটক ‘ভূমিকম্পের পরে’। আবার ১৯৭৬ সালে ঢাকা শিল্পকলা একাডেমীতে ‘ক্যাপ্টেন হুররা‘ নাটক সফলভাবে মঞ্চস্থ হওয়ায় নাট্য সমিতিকে ‘এ’ ক্যাটাগরির স্বীকৃতি প্রদান করা হয়।
সামরিক শাসন ও নানান বিধিনিষেধ জারি থাকায় পুরো আশির দশক জুড়ে উৎসব আয়োজন বন্ধ থাকে নাট্য সমিতির। ১৯৯৪ সাল থেকে আবার তা শুরু হলেও অস্থির রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং সাম্প্রদায়িক সহিংসতার কারণে বারবার তা ব্যাহত হয়। ২০১০ সালে মাসব্যাপি সফলভাবে সম্পন্ন হয় দিনাজপুর নাট্য সমিতির বিংশতিতম নাট্য উৎসব ও প্রতিযোগিতা।