কাজী বোরহান: দিনাজপুর ছাড়িয়ে তিনি সর্বত্র

দিনাজপুরের কাজী বোরহান লোকান্তরিত হলেন। একজন নাট্য শিক্ষক, উঁচু মানের অভিনেতা, কৃষিবিজ্ঞানী, ক্রীড়াবিদ, বিশেষ করে নারীদের ক্রীড়ায় যুক্ত করার উদ্যোক্তা, শিক্ষায় অগ্রণী ভূমিকা, প্রাকৃতিক চিকিৎসায় আগ্রহী এবং মানুষ হিসেবে আজীবন সংগ্রামী এক গণনায়ক—এতগুলো গুণ নিয়ে বিদায় নিলেন ৮৭ বছর বয়সে।

এই জীবন দীর্ঘ হলেও এসব মানুষের জন্য এ ক্ষণকাল। শৈশব পেরিয়ে কৈশোরেই দেশভাগের বেদনা নিয়ে তখনকার পশ্চিমবঙ্গ থেকে পূর্ব পাকিস্তানের উত্তরবঙ্গের দিনাজপুরে চলে এলেন। স্কুল-কলেজের লেখাপড়া শেষে কৃষিতে যুক্ত হন। সেই থেকে ষাটের দশকে তাঁর নানা ভাবনার উদয়। শতবর্ষী দিনাজপুরের নাট্য সমিতিতে যুক্ত হয়ে নিয়মিত নাট্যক্রিয়ায় অংশ নেন, নাট্য সমিতির বাইরেও নবরূপীতেও তিনি যুক্ত হন।

অনেক নাটকে অভিনয় করে, অনুশীলনে অংশ নিয়ে দ্রুতই নাট্য শিক্ষক হয়ে ওঠেন। পাশাপাশি দুজন অত্যন্ত মেধাবী নাট্যকর্মীকে পেয়ে যান। একজন শাজাহান শাহ, অন্যজন মাজেদ রানা। একজন নাটকের সংগঠক, পরিচালক। অন্যজন অসাধারণ অভিনেতা। এমনি করে অনেক অভিনেতা-অভিনেত্রী পেয়ে যান।

সেই ষাটের দশকেই দিনাজপুর আলোড়িত হয়েছিল নাট্যচর্চায়। কাজী বোরহান এখানেই বৃত্তাবদ্ধ হননি। মুসলিম সমাজের সংস্কৃতিবিরোধী আচরণের বিরুদ্ধেও তিনি রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন ধর্মের সঙ্গে শিল্পের কোনো বিরোধ নেই। ক্রীড়ায় প্রবল আগ্রহী কাজী বোরহান নারীদের ক্রীড়ার জগতে নিয়ে আসার জন্যও সংগ্রাম শুরু করেন।

এই গরিব দেশ ব্যয়বহুল চিকিৎসার বিপরীতে তিনি প্রাকৃতিক চিকিৎসার কথা ভেবেছেন। রবীন্দ্রনাথও যেমন প্রায় সারা জীবনই প্রাকৃতিক চিকিৎসা এবং হোমিওপ্যাথির চর্চা করেছেন। কাজী বোরহানও ব্রতী হয়েছিলেন সেই পথে। তিনি প্রথাগত শিক্ষক ছিলেন না, কিন্তু স্বতঃস্ফূর্তভাবেই হয়ে উঠেছিলেন ‘স্যার’। ক্লাসরুমের স্যারের সীমাবদ্ধতা আছে।

কিন্তু এ রকম স্যারের কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। অজস্র, অসংখ্য তাঁর ছাত্র। এ রকম ‘স্যার’ তখনো বিরল ছিলেন, এখন আরও বিরল। এ রকম একটা প্রজাতি দ্রুতই বিলীন হতে চলেছে।
দিনাজপুর একদা ছিল বিশাল এক জেলা। রেডক্লিফ এই জেলাটাকেই দ্বিখণ্ডিত করে দিল। দিনাজপুর নামেই ভারতের পশ্চিমবঙ্গে আরেকটি জেলা রইল।

মাঝখানে হিলি সীমান্ত। ওপারে বালুরঘাট। সম্প্রতি সেই দিনাজপুর ভেঙে হয়েছে আরও এক দিনাজপুর। বাংলার সংস্কৃতি অখণ্ড হলেও মাঝখানে প্রহরারত সীমান্তরক্ষী বাহিনী। এর মধ্যেই সংস্কৃতির অখণ্ডতা রক্ষার যাঁরা অভিভাবক, তাঁদের মধ্যে কাজী বোরহান অন্যতম। পাকিস্তানের ২৪ বছর সংস্কৃতিকে ভাঙার এবং ইসলামি তমদ্দুনকে রক্ষার বিরুদ্ধে আমাদের সবাইকে লড়াই করতে হয়েছে। যার পথ ধরেই মুক্তিযুদ্ধের পর আত্মপরিচয়ে শক্তি অর্জন করে অস্ত্র পরিত্যাগ করে শিল্পের একটি বড় জায়গা হলো নাটক।

ঢাকার সমান্তরালে দিনাজপুরের নাট্যচর্চা একটি বিশিষ্ট জায়গা হয়ে দাঁড়াল। এই বাংলা নাটকের ইতিহাস বলতে বোঝায় ১৯৭২-এ কিছু মুক্তিযোদ্ধার কলকাতায় নাটক দেখা থেকেই নাকি এর সূচনা। এটা যে কত বড় ভুল, তার প্রমাণ কাজী বোরহান, শাজাহান শাহ, মাজেদ রানা।

শতবর্ষের বেশি সময় ধরে এই বাংলাতেও নাট্যচর্চা হয়েছে।

একটা বিশাল নাট্যপ্রেমী দর্শকও ছিল আর চর্চার ক্ষেত্রেও একটা বড় নাট্যকর্মী দলও এখানে অনিয়মিত হলেও নাট্যচর্চায় রত ছিল। কাজী বোরহানের মতো মানুষেরা সমাজের কাছেও গ্রহণযোগ্য শুধু নয়, শ্রদ্ধেয় করে তুলেছিলেন।

কাজী বোরহানের সঙ্গে আমার দেখা হয় সেই ৪২ বছর আগে। একটা সাইকেল ছিল তাঁর নিত্যসঙ্গী। আবার কুড়ি বছর আগে যখন দেখা হয়, তখনো সাইকেল তাঁর নিত্যসঙ্গী। একটা প্রজন্ম তখন বিশ্বাস করত ‘প্লেইন লিভিং অ্যান্ড হাই থিংকিং’। সে বাংলার এক স্বর্ণযুগ। নির্লোভ মানুষগুলো নিজেদের চিন্তা না করে ঝাঁপিয়ে পড়ত দেশের সেবায়। হয়তো আমাদেরই সৌভাগ্য হয়েছে এই সব মানুষকে দেখার, কাছাকাছি আসার।

কিন্তু কী দেশ কী হয়ে গেল! বিত্ত, অর্থ, ক্ষমতার কী দুর্দমনীয় আগ্রাসন! চারদিকে একটা লুটপাটের হিড়িক পড়ে গেল। নদী লুট হয়ে যাচ্ছে, পাহাড় লুট হয়ে যাচ্ছে, মানুষের ন্যায্য অধিকার লুট হয়ে যাচ্ছে। এই সব লুট করে আবার বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে নির্বিঘ্নে। প্রতিদিনই লুটের সংবাদ। এই সংবাদ আর কাজী বোরহানকে দেখতে-শুনতে হবে না। আমার দক্ষিণা স্যার, লতিফ স্যার, জলিল স্যারকেও দেখতে হলো না।

সবচেয়ে বড় কষ্টের জায়গা—কাজী বোরহানরা যেসব প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন, তার নিরাপত্তা দেবে কে? রাজনীতিতে কল্যাণকামিতার অবশেষও যখন থাকছে না, তখন মূল্যবোধেরও চরম বিপর্যয় ঘটেছে। কাজী বোরহানরা তখন বেঁচে ছিলেন মানুষের মূল্যবোধের পাহারাদার হিসেবে।

রবীন্দ্রনাথ সভ্যতার সংকটে হতাশা ব্যক্ত করেছেন। বিদ্যাসাগরের শেষ জীবনও অনিশ্চিত বেদনার মধ্য দিয়ে গেছে। সে ক্ষেত্রে বলতে হবে, কাজী বোরহানের শেষ জীবনে একটা আশ্রয় ছিল তাঁর পরিবার; পরম স্নেহে, মমতায় এবং পরিচর্যায় কেটেছে তাঁর মেয়ে বন্যার কাছে। অন্য মেয়েরাও তাঁর সঙ্গী হয়েছে। তিনি পরিবারকে গুরুত্ব দিতেন। মেয়েটি সু-অভিনেত্রী ছিলেন। এটা তাঁর ভাগ্য নয়, এভাবেই তিনি তৈরি করেছিলেন তাঁর পরিবার। তিনি শেষ জীবনে এসে কিছু পুরস্কার পেয়েছেন। সেগুলোকে তিনি তাঁর নিষ্ঠার ফল বলেই বিবেচনা করতেন।

মাত্র কয়েক দিন আগেই তিনি আমাদের ‘কল্যাণী’ নাটক দেখতে এসেছিলেন। নাটক শেষে আমি মঞ্চ থেকে নেমে একজন শ্রদ্ধেয় অভিনেতার সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। তিনি উষ্ণ করমর্দন করে বলেন, ‘আপনারা তো বলছেন আজকের এই মুহূর্তে, কিন্তু অনাগত ভবিষ্যতে এই সত্যের পরিবর্তন হবে। কারণ, সত্য নিয়ত পরিবর্তনশীল।’ কিন্তু সেদিন কাজী বোরহানের মতো আমরা কেউ থাকব না। তবে পরিবর্তন আসুক, প্রচণ্ড খরার পর যেমন প্রশান্তির বৃষ্টি নামে, তেমনি নামুক। কাজী বোরহানকে আমাদের আজ কিছুই দেওয়ার নেই। তবে টিনের তলোয়ার উঁচিয়ে তাঁকে জানাই লাল সালাম।

লেখক: মামুনুর রশীদ, নাট্যব্যক্তিত্ব

কাজী বোরহান উদ্দীনকে সংবর্ধনা

নাট্যকলায় সামগ্রিক অবদানের জন্য শিল্পকলা পদক-২০১৫ পাওয়ায় দিনাজপুরবাসীর পক্ষ থেকে অধ্যক্ষ কাজী বোরহান উদ্দীনকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছে। দিনাজপুর নাট্য সমিতি মঞ্চে গত বুধবার রাতে বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং শতাধিক শিল্পী তাঁকে ওই সংবর্ধনা দেন।

অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন নাট্য সমিতি ও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি মির্জা আনোয়ারুল ইসলাম। অনুষ্ঠানে দিনাজপুরের নাট্যাঙ্গনে কাজী বোরহান উদ্দিনের ভূমিকা এবং তাঁর অভিনয় নিয়ে আলোচনা করেন নবরূপীর সাধারণ সম্পাদক শাহাজাহান শাহ।

শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন নাগরিক উদ্যোগের সভাপতি আবুল কালাম আজাদ, নাট্য সমিতির সাধারণ সম্পাদক রেজাউর রহমান, উদীচী জেলা সংসদের সাধারণ সম্পাদক সত্য ঘোষ, মহিলা পরিষদের সভাপতি কানিজ রহমান, কলেজিয়েট গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ হাবিবুল ইসলাম, গবেষক মাসুদুল হক, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সাধারণ সম্পাদক সুলতান কামাল উদ্দিন, রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী নূরুল মতিন, জেলা কালচারাল অফিসার মো. আসফউদ্দৌলা, সাংস্কৃতিক কর্মী ময়েন উদ্দিন চিশতি, সাংস্কৃতিক সংগঠন ভৈরবীর সাধারণ সম্পাদক মো. রহমতুল্লাহ প্রমুখ।

সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে কাজী বোরহান উদ্দিন বলেন, ‘দেশে ধর্মান্ধতা, মৌলবাদী অপশক্তিকে রুখতে হলে সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোকে দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখতে হবে।

যত দিন বেঁচে থাকব, নাটকের সঙ্গেই থাকতে চাই।’ তিনি দিনাজপুরের বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতা-কর্মীদের দৃঢ়তার সঙ্গে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার আহ্বান জানান।

প্রসঙ্গত, গত ৫ মে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ তাঁর হাতে শিল্পকলা পদক-২০১৫ তুলে দেন।

‘শিল্পকলা পদক’ পেল শতবর্ষী প্রতিষ্ঠান দিনাজপুর নাট্য সমিতি

সৃজনশীল সাংস্কৃতিক সংগঠন হিসেবে ‘শিল্পকলা পদক’-২০২০ পেয়েছে দিনাজপুরের ঐতিহ্যবাহী শতবর্ষী প্রাচীন নাট্য প্রতিষ্ঠান দিনাজপুর নাট্য সমিতি। এছাড়া দেশের শিল্প-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে জাতীয় পর্যায়ে বিশেষ অবদানের জন্য বাংলাদেশ শিল্পকলা অ্যাকাডেমির উদ্যোগে ১৮ গুনী ও ২ সংগঠনকে ‘শিল্পকলা পদক ২০১৯ ও ২০২০’ প্রদান করা হয়।

গত ২২ সেপ্টেম্বর ঢাকায় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালা মিলানয়তনে এই পদক প্রদান করা হয়। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে ভার্চুয়ালি উপস্থিত ছিলেন রাষ্ট্রপতি জনাব মো. আবদুল হামিদ। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, এমপি এবং সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আবুল মনসুর। সভাপতিত্ব করেন সংস্কৃতিবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী কে.এম খালিদ এবং স্বাগত বক্তব্য প্রদান করেন অ্যাকাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী।

অনুষ্ঠানে সভাপতি সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ এর হাত হতে দিনাজপুর নাট্য সমিতিকে দেয়া পদক গ্রহন করেন নাট্য সমিতির সভাপতি চিত্ত ঘোষ।

‘শিল্পকলা পদক’ ২০১৯ ও ২০২০ প্রাপ্ত গুণীজনরা হলেন- নাট্যকলায় মাসুদ আলী খান, মলয় ভৌমিক, কণ্ঠসংগীতে হাসিনা মমতাজ, মাহমুদুর রহমান বেণু, চারুকলায় আবদুল মান্নান, শহিদ কবীর, চলচ্চিত্রে অনুপম হায়াৎ, শামীম আখতার, নৃত্যকলায় লুবনা মারিয়াম, শিবলী মোহাম্মদ, লোকসংস্কৃতে শম্ভু আচার্য্য, শাহ আলম সরকার, যন্ত্রসংগীতে মো. মনিরুজ্জামান, মো. সামসুর রহমান, ফটোগ্রাফিতে এম এ তাহের আ ন ম শফিকুল ইসলাম স্বপন, আবৃত্তিতে হাসান আরিফ, ডালিয়া আহমেদ, সৃজনশীল সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানট দিনাজপুর নাট্য সমিতি।

 

উল্লেখ্য, দেশের শিল্প-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে জাতীয় পর্যায়ে বিশেষ অবদানের জন্য গুণীজনদের অবদানকে সম্মান ও স্বীকৃতি জানাতে বাংলাদেশ শিল্পকলা অ্যাকাডেমির উদ্যোগে ২০১৩ সাল থেকে ‘শিল্পকলা পদক’ প্রদান করা হয়। করোনা মহামারীর কারণে ‘শিল্পকলা পদক’ এর অনুষ্ঠান স্থগিত থাকায় এ বছর ২০১৯ ও ২০২০ দু’বছর এর পদক একসঙ্গে প্রদান করা হয়। ২০১৯ সালে একটি সংগঠনসহ দশজন ও ২০২০ সালে একটি সংগঠনসহ দশজন করে মোট বিশ জনকে এ পদক প্রদান করা হয়।

উনিশ শতকের শেষ প্রান্তে মঞ্চ নাটক চর্চার প্রাণকেন্দ্র কলকাতার ঢেউ দিনাজপুরকেও আন্দোলিত করে। ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দের ৭ ডিসেম্বর প্রথম নাটক ‘জয়দ্রথ’ অভিনীত হয় দিনাজপুরের রথের মাঠে। ১৮৮৫ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে দিনাজপুরে ‘ডায়মন্ড জুবিলী থিয়েটার’ কোম্পানি গঠিত হয়। ১৯০৪ সালে দিনাজপুর শহরের মধ্যস্থলে ক্ষেত্রীপাড়ায় প্রধানত দিনাজপুরের নাট্য আন্দোলনের অগ্রদূত বিশিষ্ট মঞ্চাভিনেতা ও নাট্যকার শ্রী হরিচরণ সেনের উদ্যোগে ‘ডায়মন্ড জুবিলী থিয়েটার’ হল স্থাপিত হয়। পরবর্তীকালে প্রাইভেট থিয়েটার রূপান্তরিত হয় শৌখিন নাট্যচর্চায়। কিন্তু এটির স্থায়িত্ব বেশি দিন হয়নি। এটি চলাকালে নাট্যমোদিদের মতের অমিল ঘটে এবং ১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দের ২১ জুন প্রায় ২৬ দশমিক ২৫ শতাংশ ভুমির উপর স্থাপিত হয় ‘ দিনাজপুর নাট্য সমিতি ‘।

অবিভক্ত দিনাজপুর জেলার বালিয়াডাঙ্গী থানার শাহবাজপুর গ্রামের নিবাসী শ্রীযুক্ত বসন্ত কুমার দাস-এর দুই পুত্র শ্রীযুক্ত ভবানী কুমার দাস ও শ্রীযুক্ত শিশির কুমার দাস এবং এক কন্যা শ্রীমতি কাঞ্চন মনি চৌধুরানী (স্বামী শ্রীযুক্ত পতিমাধব চৌধুরী, সাকিনÑ মুকুরিয়া, ডাকঘরÑ বারসঁই ঘাট, জেলা পূর্ণীয়া,বিহার।) তাঁদের নামীয় ওই পরিমান ভুমি দিনাজপুর নাট্য সমিতি’র নামে দান করেন।

দিনাজপুর নাট্য সমিতির প্রধান পৃষ্ঠপোষকতা করেন গুদড়ীবাজারের (বর্তমানে চকবাজার নামে পরিচিত) নাট্যপ্রিয় জমিদার রাধা গোবিন্দ রায় চৌধুরী। এ ছাড়াও এর প্রতিষ্ঠায় ভূপাল চন্দ্র সেনেরও অগ্রণী ভূমিকা ছিল। দিনাজপুরের মহারাজা জগদীশ নাথ রায়, ডাক্তার যামিনী সেন, নিশিকান্ত রায় চৌধুরী, গিরিজা মোহন নিয়োগী, মীর হামাত হোসেন প্রমুখের সহযোগিতায় ‘চন্দ্রগুপ্ত’ নাটকের মঞ্চায়নের মাধ্যমে দিনাজপুর নাট্য সমিতির প্রথম যাত্রা শুরু হয়। কুলোদ বাবু, কুনুবাবু, বিভূতি চাঁদ, হিরণ¥য় বাবু প্রমুখ সে সময় দিনাজপুর নাট্য সমিতি প্রযোজিত বিভিন্ন নাটকে স্ত্রী চরিত্রে অভিনয় করে নাট্যাঙ্গনে বেশ সুনাম অর্জন করেন।

বিশের দশকে নাট্য সমিতির গুণগত পরিবর্তন ঘটতে শুরু করে। তখন থেকে দিনাজপুর নাট্য সমিতি বিত্তবানদের অনুদান ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে এবং ক্রমশ দর্শকবৃন্দের ওপর নির্ভরশীল হয়ে ওঠে। এ সময় হতে পৃষ্ঠপোষকদের ভূমিকায় জমিদার শ্রেণির উপস্থিতি ধীরে ধীরে লুপ্ত এবং পাশাপাশি নাটকের টিকিট বিক্রি শুরু হয়। একই সময়ে দিনাজপুর নাট্য সমিতি মঞ্চে প্রফুল্ল, রাজা হরিশ চন্দ্র, শাহজাহান, মহারাজা নন্দ কুমার, শ্রী দূর্গা, কর্ণাজ্জুন, রানা প্রতাপাদিত্য, কেদার রায়, আলমগীর, ফুল্লরা, মণীষা, প্রফুল্ল প্রভৃতি সামাজিক, পৌরাণিক ও ঐতিহাসিক নাটকের অনুপ্রবেশ ঘটে। কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, সাহিত্যিক তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়, নাট্য ব্যক্তিত্ব মন্মথ রায়, চলচ্চিত্রকার রাজেন তরফদার, নটরাজ শিব প্রসাদ কর, জাদু সম্রাট পি.সি. সরকার (প্রতুল চন্দ্র সরকার), জনপ্রিয় চিত্রনায়ক রহমান, সুভাষ দত্ত (পটলা) সহ নাট্যকারদের স্মৃতিধন্য এই নাট্য সমিতি।

দিনাজপুরে নাট্য আন্দোলনের গুণিজনদের অন্যতম ছিলেন দিনাজপুর রঙ্গমঞ্চের প্রবাদ পুরুষ শিব প্রসাদ কর ও দিনাজপুর নাট্যাভিনয়ের জনক হরি চরণ সেন। ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দে তারাশংকরের ‘দুই পুরুষ’ উপন্যাসের নাট্যরূপ দেন শিবপ্রসাদ কর। ‘দুই পুরুষ’ নাটকটির আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে দিনাজপুরের নাট্য সমিতিতে নাটক দেখতে আসেন সাহিত্যিক ও উপন্যাসিক তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়। রঙ্গমঞ্চ ও নাট্য পরিচালনার কর্ণধার ছিলেন শিব প্রসাদ কর। দিনাজপুরে নাট্য অভিনয়ের সাথে একটানা ৩৫ বছর নাট্য সমিতি মঞ্চে সুদক্ষ সারথীর ভূমিকায় তাঁর নিরলস অবদান ছিল দু’যুগেরও বেশি। নাট্য সমিতির সমৃদ্ধির যুগে ১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত নাট্য সমিতির মঞ্চায়িত নাটকের মধ্যে মন্যু রায়ের চাঁদ সওদাগর, সীতা, সাবিত্রী ও খনা নাটক এবং শরৎচন্ত্রের উপন্যাস অবলম্বনে নাট্য রূপায়িত বৈকুন্ঠের উইল, মহেষ, রামের সুমতি ছাড়াও পৌরাণিক নাটক স্বর্ণলতা, ঐতিাসিক নাটক রানা রনজিৎ সিংহ, সিরাজ উদ্দৌলা, টিপু সুলতান, শাহজাহান, আলমগীর, হায়দার আলী নিয়মিতভাবে দিনাজপুর নাট্য সমিতি মঞ্চে সাফল্যের সঙ্গে মঞ্চস্থ হয়েছে।

১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে দেশ বিভাগের পর পাঁচ বছর দিনাজপুর নাট্য সমিতি নিষ্প্রভ থাকে। এর পরবর্তী সময়ে নাট্য সমিতিতে একে একে অভিনীত হয়েছে ঐতিহাসিক নাটক মিশর কুমারী, মীর কাশিম (মনাথ রায়), সিরাজ উদ্দৌলা (শচীন্দ্রনাথ সেন গুপ্ত), টিপু সুলতান (মহেন্দ্রগুপ্ত), শাহজাহান (দ্বিজেন্দ্র লাল রায়), সামাজিক নাটক কালিন্দী (তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়), মাটির ঘর (বিধায়ক ভট্টাচার্য), দুই পুরুষ (তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়) এবং হাস্যরসাত্মক নাটক ‘তাইতো’ প্রভৃতি। ১৯০৪ খ্রিষ্টাব্দে সম্ভবত দিনাজপুর নাট্য সমিতি প্রযোজিত এবং আলী মনসুর রচিত ‘পোড়াবাড়ী’ নাটকটিতে প্রথম মুসলিম মহিলা শিল্পীর আবির্ভাব ঘটে। এ ছাড়া প্রখ্যাত অনুষ্ঠান সংগঠক শ্যামা ব্যানার্জির তত্ত্বাবধানে শ্যামলী নাটকটি অভিনীত হয় যেখানে কেবল মাত্র মহিলা শিল্পীগণ সকল নাট্য চরিত্রে অভিনয় করেন।

ষাটের দশকে নাট্য সমিতি মঞ্চে অভিনীত নাটকের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো কলির জীন (তাজ মিলুর রহমান, ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দ), এরাও মানুষ (সন্তোষ সেন, ১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দ) কাঞ্চন রঙ্গ (শম্ভু মিত্র ও অমৃত মৈত্র, ১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দ) বৌদির বিয়ে, লবণাক্ত, মরাস্রোত, কুহকিনী, ফিংগার প্রিন্ট ইত্যাদি।

১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে দিনাজপুর নাট্য সমিতি প্রতি বছর আন্তঃজেলা নাট্যোৎসব ও অভিনয় প্রতিযোগিতা শুরু করে। এই নাট্যোৎসব থেকে সমিতি নিয়মিত দর্শনীর বিনিময়ে নাটক মঞ্চস্থ করে আসছে। এর ফলে নতুন নাট্য গোষ্ঠীর সৃষ্টি, নাট্যচর্চার গতিশীলতা বৃদ্ধি এবং বিভিন্ন নাট্য গোষ্ঠীর মধ্যে ভাবের আদান প্রদানের মাধ্যমে নাট্যচর্চার মান উন্নয়নের ক্ষেত্রে এই প্রতিযোগিতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে নাট্য সমিতিতে প্রচুর নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে। ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে দিনাজপুর নাট্য সমিতি ময়মনসিংহ আন্তঃজেলা নাট্যোৎসবে ‘ভূমিকম্পের পরে’ নাটকটি মঞ্চায়নের মাধ্যমে প্রতিযোগিতায় ঘোষিত ১১ টির মধ্যে ৯টি পুরস্কার লাভ করে। ভূমিকম্পের আগে, বাকী ইতিহাস, অমৃতস্য পুত্র, এই দশকের মঞ্চে, সম্রাট, ভূমিকম্পের পরে, সুবচন নির্বাসনে, উল্কা, ভেঁপুতে বেহাগ, ফিংগার প্রিন্ট, অন্ধকারের নীচে সূর্য, ভাড়াটে চাই, ক্যাপ্টেন হুররা, আলিবাবা, কুহকিনী, সেনাপতি, যদিও সন্ধ্যা, নতুন মানুষ, ক্ষত বিক্ষত, পাহাড়ী ফুল, তৃতীয় পুরুষ, এখনও ক্রীতদাস, তোমরাই, দ্যাশের মানুষ, হিসাবের খাতা, দেওয়ান গাজীর কিসসা, মাগানা সওয়ারী, কেনা রাম বেচারাম, একাত্তরের পালা, এই রোদ এই বৃষ্টি, মানুষ, নৈশ ভোজ, স্পধা, ঝিঁঝিঁ পোকার কান্না, হত্যারে প্রভৃতি আরো অনেক নাটক।

পরবর্তী সময়ে সংস্থাটির আত্মবিকাশ ও উন্নতি সাধনের ভূমিকায় যাদের সহযোগিতা অবিচ্ছিন্ন তারা হলেন- কাজী বোরহান, মকবুল মোক্তার (প্রয়াত), গুরুদাশ তালুকদার (প্রয়াত), আদল সরকার (প্রয়াত), ডা. হাফিজ উদ্দীন (প্রয়াত), নিত্য গোপাল, কমলেশ দা (প্রয়াত), মনুদা (প্রয়াত), তালেব ভাই (প্রয়াত), আকবর আলী ঝুনু (প্রয়াত), শাহ রহমত বাবু ভাই (প্রয়াত), মির্জা আনোয়ারুল ইসলাম তানু (প্রয়াত), মোহন কুমার দাশ (প্রয়াত) প্রমুখ।

২০১৩ খ্রিষ্টাব্দের দিনাজপুর নাট্য সমিতির শতবর্ষ পূর্তি হয়েছে। ২০১৫ খ্রিস্টাব্দের ২৯ অক্টোবর থেকে ২১ নভেম্বর পর্যন্ত নাট্য সমিতির একবিংশ নাট্যোৎসব শুরু হয়েছিল। নাট্য সমিতি যামিনীর শেষ সংলাপ নাটকটির মধ্যদিয়ে নাটকের শতবর্ষ পূর্তি ও একবিংশ দিনাজপুর নাট্যোৎসব শুরু করেছিল। এরপর ’আতর আলীর নীলাভ পাট’, ’সাদা কাগজ’ ’কনক সরোজিনী’ ‘নন্দিনীর পালা’ সহ ১০টি নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে শতাধিক বর্ষী প্রাচীন দিনাজপুর নাট্য সমিতির মঞ্চে।

মির্জা আনোয়ারুল ইসলাম তানুর প্রয়াণ দিবসে নাট্য সমিতি স্মরণ

মির্জা আনোয়ারুল ইসলাম তানুর প্রয়াণ দিবসে নাট্য সমিতি স্মরণ –

বিশিষ্ট রাজনৈতিক, সামাজিক সাংস্কৃতিক ব্যাক্তিত্ব, দিনাজপুর নাট্য সমিতির দীর্ঘদিনের সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতি, দিনাজপুরের অভিভাবক সবার শ্রদ্ধেয়জন মির্জা আনোয়ারুল ইসলাম তানুর পঞ্চম মৃত্যুবার্ষিকী আজ ২৫ জানুয়ারি ‘২২, দিনাজপুর নাট্য সমিতি তাঁর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করে।
সন্ধ্যায় নাট্য সমিতি গৃহে বৈঠকি স্মরণ সভার সভাপতিত্বে করেন সমিতির সহ-সভাপতি জনাব শহিদুল ইসলাম।
স্মরণ সভায় আলোচনায় অংশ নেনে সাধারণ সম্পাদক রেজাউর রহমান রেজু, সহসাধারণ সম্পাদক রবিউল আউয়াল খোকা, নাট্যাধ্যক্ষ তরিকুল আলম তরু, নাট্য নির্দেশক নয়ন বার্টেল, সম্বিত সাহা, সদস্য টংকনাথ অধিকারি, সাইফুল ইসলাম প্রমূখ।
স্মরণ সভায় বক্তাগণ প্রয়াত মির্জা আনোয়ারুল ইসলাম তানুর বিভিন্ন দিক তুলে ধরে বলেন তাঁর মত উদার মনের মানুষ এবং সংগঠক পাওয়া দুষ্কর।
মানুষের জন্যই তিনি সারা জীবন নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন। তাঁর নৈতিকতা ও সততা ছিল প্রশ্নাতীত। তিনি ছিলেন মনেপ্রাণে একজন অস্প্রদায়িক ও মানবিক মানুষ। নাট্য সমিতির তিনি ছিলেন প্রাণপুরুষ।
তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও নেত্রীত্বে স্বাধীনতা যুদ্ধে খানসেনা কর্তৃক ধ্বংসপ্রাপ্ত নাট্য সমিতি পূণরায় গড়ে তুলা সম্ভব হয়েছিল। দিনাজপুরের সকল সামাজিক সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে তিনি ছিলেন অগ্রসৈনিক।
তিনি ছিলেন দিনাজপুরে অভিভাবক তাঁর মৃত্যুতে দিনাজপুরের যে ক্ষতি হয়েছে তা সহজেই পূরণ হবার নয়।

মির্জা আনোয়ারুল ইসলাম

ভাষাসৈনিক ও সিপিবি নেতা মির্জা আনোয়ারুল ইসলাম

ভাষাসৈনিক ও মুক্তিযোদ্ধা এবং সিপিবি দিনাজপুর জেলা কমিটির সাবেক সভাপতি মির্জা আনোয়ারুল ইসলাম (৮৩) গতকাল বুধবার দুপুরে নিজ বাড়িতে ইন্তেকাল করেছেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তিনি স্ত্রী, এক ছেলে, এক মেয়ে, আত্মীয়স্বজন ও অনেক শুভাকাঙ্ক্ষী রেখে গেছেন।
অস্ট্রেলিয়া থেকে মেয়ে ফারজানা আনোয়ার ও নিউইয়র্ক থেকে ছেলে মির্জা আনাতুল ইসলাম ফেরার পর আগামীকাল শুক্রবার বাদ আসর মির্জা আনোয়ারুল ইসলামকে দাফন করা হবে।
মির্জা আনোয়ারুল ইসলামের মৃত্যুতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী, সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান, জাতীয় সংসদের হুইপ ইকবালুর রহিম শোক প্রকাশ এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন।
মির্জা আনোয়ারুল ইসলাম তৎকালীন ছাত্র ইউনিয়নের নেতা হিসেবে ১৯৬২ সালের ছাত্র আন্দোলন ও ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান এবং ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
১৯৮৫ সাল থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট দিনাজপুরের আহ্বায়ক ও সভাপতি এবং দিনাজপুর উদীচীর সহসভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।
আনোয়ারুল ইসলাম ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি এবং দলটির কন্ট্রোল কমিশনের সদস্য ছিলেন।