দেশবরেণ্য নাট্যজন কাজী বোরহানের চিরবিদায়
সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা-ভালবাসায় জানাজা ও দাফন সম্পন্ন, বিভিন্ন মহলের শোক প্রকাশ
বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি পদকপ্রাপ্ত দেশবরেণ্য নাট্যাভিনেতা, নাট্যনির্দেশক ও নাট্যসংগঠক দিনাজপুর নাট্য সমিতির নাট্যাধ্যক্ষ কাজী বোরহান উদ্দীন রোববার (২৩ জুন ২০২৪) চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেছেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)।
পরিবার সূত্রে জানা যায়, কাজী বোরহান উদ্দীনের জীবনে শেষ কোন অনুষ্ঠানে যোগদান ছিল শুক্রবার ২১ জুন। সেদিন দিনাজপুর নাট্য সমিতির ১শ ১১ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে তিনি প্রধান অতিথি হিসেবে আসন অলংকিত করেন। শনিবার (২২ জুন) সকালে শহরের বড়বন্দরস্থ নিজ বাড়ীতে তিনি অসুস্থ্য হয়ে পড়লে তাঁকে স্থানীয় একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রোববার বেলা সাড়ে ১২ টায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৭ বছর। তিনি ৩ মেয়েসহ অসংখ্য আত্মীয় স্বজন ও গুনগ্রাহী রেখে গেছেন। তার সহধর্মীনি কাজী তাহেরা আহমেদ ২০২২ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি ইন্তেকাল করেন। মহিলা পরিষদ নেত্রী কাজী তাহেরা ছাত্র আন্দোলনে নারী নেতৃত্বে ব্যাপক ভুমিকা রাখেন।
এদিকে গতকাল রোববার সন্ধ্যার পরে তার মরদেহ প্রথমে নবরূপীতে এরপর দিনাজপুর নাট্য সমিতিতে কিছু সময়ের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে সংগঠনের পক্ষ থেকে তার আত্মার মাগফেরাত কামনা করে মরদেহে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন সভাপতি সাধারণ সম্পাদকসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ। রাত ৮ টায় দিনাজপুর ইনস্টিটিউট প্রাঙ্গণে জেলা সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের ব্যবস্থাপনায় মরহুমের প্রতি সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনের আয়োজন করা হয়।
এখানে দিনাজপুরের বিভিন্ন রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সংগঠন সমুহের পক্ষ থেকে বিপুল সংখ্যক মানুষ তার প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন। একই স্থানে বাদ এশা রাত সাড়ে ৯ টায় তাঁর জানাজা শেষে সোনাপীর গোরস্থানে তার মা এবং স্ত্রীর কবরের পাশে তার দাফন কাজ সম্পন্ন করা হয়। শ্রদ্ধানিবেদন, জানাজা ও দাফন কাজে সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের সর্বস্তরের বিপুল সংখ্যক মানুষ অংশগ্রহণ করেন।
২৫ জুন মঙ্গলবার বাদ আসর শহরের চুরিপট্টিস্থ উৎসব কমিউনিটি সেন্টারে মরহুমের দোয়া খায়ের এর আয়োজন করা হয়েছে। পরিবারের পক্ষ থেকে সকলকে অনুষ্ঠানে অংশ নেয়ার জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছে।
উল্লেখ্য, গুণীশিল্পী কাজী বোরহান উদ্দীন নাট্যকলায় সামগ্রিক অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ ‘শিল্পকলা পদক-২০১৫’ পান। ২০১৬ সালের ৫ মে শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালা মিলনায়তনে তার হাতে পদক তুলে দেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। উপস্থিত ছিলেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, সচিব আকতারী মমতাজ এবং বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী। সম্মাননাস্বরূপ রাষ্ট্রপতি তার হাতে এক লাখ টাকা, স্বর্ণপদক, উত্তরীয়, সনদপত্র এবং ফুলের তোড়া তুলে দেন।
বাংলাদেশের নাট্যকলাকে নিয়ে কাজ করা এবং এর উন্নয়নে নিজের পুরো জীবনকে সমর্পিত করাদের মধ্যে অন্যতম একজন হলেন কাজী বোরহান উদ্দীন। তিনি তার জীবনের পুরোটা সময় ব্যয় করেছেন এই শিল্পচর্চার পিছনে। বিনিময়ে পেয়েছেনও অসংখ্য মানুষের ভালবাসা এবং অসংখ্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার।
কাজী বোরহান উদ্দীনের নির্দেশিত নাটকের সংখ্যা প্রায় ২৫টি। এগুলোর মধ্যে ’ভুমিকম্পের পরে’ নাটকটি বিভিন্ন নাট্য উৎসবে বেশ কিছু পুরষ্কার লাভ করেছে। তাঁর অভিনীত নাটকের সংখ্যা অন্তত ৬৫ টি। মুকুল ফৌজ প্রযোজিত ’বন্দী বীর’ নাটকে তাঁর অভিনয় বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। দিনাজপুর নাট্য সমিতি মঞ্চে এ নাটক বহুবার মঞ্চস্থ হয়েছে।
উল্লেখযোগ্য অন্যান্য নাটকগুলোর মধ্যে রয়েছে ’পাহাড়ীফুল’ ’যদিও সন্ধ্যা’ ইত্যাদি। পাহাড়ীফুল নাটকটি এতবেশি জনপ্রিয় হয়েছিলো যে এক নাগাড়ে ১৫/১৬ রজনী মঞ্চস্থ হয়েছিল। ’যদিও সন্ধ্যা’ নাটকে অভিনয়ের জন্য তিনি রংপুর নাট্য উৎসবে শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কার লাভ করেছিলেন। নাট্যাভিনেতা, নাট্যনির্দেশক ও নাট্যসংগঠক কাজী বোরহান উদ্দীনের জন্ম ১৯৩৭ সালের ২৮ মে পশ্চিম বঙ্গের বর্ধমান জেলার সাহাজদপুরে।
তাঁর পিতা কাজী আব্দুর রহমান এবং মাতা মাকসুদা খাতুন। গোলাপবাগ জুনিয়র মাদ্রাসায় প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হওয়ার মধ্য দিয়ে তাঁর শিক্ষা জীবন শুরু। এরপর জিলা স্কুলে ৫ম শ্রেণিতে ভর্তি এবং সেখানে থেকে ১৬৫৪ সালে ম্যাট্রিকুলেশন সম্পন্ন করেন। পরবর্তীতে সুরেন্দ্রনাথ কলেজ থেকে ১৯৫৬ সালে ইন্টারমিডিয়েট এবং ১৯৬০ সালে বাণিজ্যে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন।
জিলা স্কুলে অধ্যায়নকালে বিভিন্ন দিবস উপলক্ষে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কবিতা পাঠ, ধারা-বর্ণনা, শিক্ষকদের রচিত নাটকে বিভিন্ন চরিত্রে অংশগ্রহণ করে শিক্ষক ও দর্শকবৃন্দের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। সেই থেকেই নাট্য তার জগতে পদার্পণ। কলেজ জীবনে ’গোড়ায় গলদ’ নাটকে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে বেশ সুনাম অর্জন করেন তিনি। সেই থেকেই তিনি নাট্যচর্চাকে জীবনে বিশেষ গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করেন।
বিখ্যাত নাট্যদল ’দিনাজপুর নাট্য সমিতি’র সদস্য হওয়ার মাধ্যমে তিনি প্রথম কোনো পেশাদারী নাট্যসংগঠনে প্রবেশ করেন। পরবর্তীতে প্রতিষ্ঠা করেন ’নবরূপী’; তিনি এর প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। এছড়া তিনি খাজা নাজিমুদ্দিন মুসলিম হল ও পাবলিক লাইব্রেরীর কার্যকরী পরিষদের সদস্য, দিনাজপুর ইনস্টিটিউটের সভাপতি ছিলেন। এছাড়া তিনি আমৃত্যু দিনাজপুর নাট্য সমিতির নাট্যাধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
বিভিন্ন মহলের শোক প্রকাশ
এদিকে নাট্যজন কাজী বোরহান উদ্দীনের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন জাতীয় সংসদের হুইপ ইকবালুর রহিম এমপি, দিনাজপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান ফিজার এমপি ও সাধারণ সম্পাদক আলতাফুজ্জামান মিতা, সাবেক এমপি মনোরঞ্জন শীল গোপাল, দিনাজপুর পৌরসভার সাবেক মেয়র বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. সফিকুল হক ছুটু, দিনাজপুর নাট্য সমিতির সভাপতি চিত্ত ঘোষ ও সাধারণ সম্পাদক রেজাউর রহমান রেজু, বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন (বিএমএ) জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক ডা. বি কে বোস, নবরূপীর সভাপতি আব্দুস সামাদ ও সাধারণ সম্পাদক শিফাত-ই-জাহান শিউ, দিনাজপুর জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক সুব্রত মজুমদার ডলার, দিনাজপুর প্রেসক্লাবের সভাপতি স্বরুপ বকসী বাচ্চু ও সাধারন সম্পাদক গোলাম নবী দুলাল, দিনাজপুর সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি ওয়াহেদুল আলম আর্টিস্ট ও সাধারণ সম্পাদক মো. শাহিন হোসেন, উদীচী দিনাজপুর জেলা সংসদের সভাপতি অধ্যক্ষ হাবিবুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক সত্য ঘোষ, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট জেলা শাখার সভাপতি সুলতান কামাল উদ্দিন বাচ্চু ও সাধারণ সম্পাদক রহমতুল্লাহ রহমত, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য কানিজ রহমান এবং জেলা শাখার সভাপতি ড. মারুফা বেগম ও সাধারণ সম্পাদক রুবিনা, দৈনিক আজকের দেশবার্তা পরিবার প্রমুখ।
পৃথক শোক বার্তায় নেতৃবৃন্দ বলেন, দিনাজপুরের নাট্য জগতের আরো একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র চিরতরে নিভে গেলো। তিনি সর্বাঙ্গীনভাবে দিনাজপুরের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের সমৃদ্ধ ও আলোকিত করতে নিরন্তর প্রয়াস চালিয়েছেন। এছাড়া নেতৃবৃন্দ মরহুমের আত্মার মাগফেরাত ও শান্তি কামনা করেন এবং শোক সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করেন।