কাজী বোরহান: দিনাজপুর ছাড়িয়ে তিনি সর্বত্র

কাজী বোরহান: দিনাজপুর ছাড়িয়ে তিনি সর্বত্র

দিনাজপুরের কাজী বোরহান লোকান্তরিত হলেন। একজন নাট্য শিক্ষক, উঁচু মানের অভিনেতা, কৃষিবিজ্ঞানী, ক্রীড়াবিদ, বিশেষ করে নারীদের ক্রীড়ায় যুক্ত করার উদ্যোক্তা, শিক্ষায় অগ্রণী ভূমিকা, প্রাকৃতিক চিকিৎসায় আগ্রহী এবং মানুষ হিসেবে আজীবন সংগ্রামী এক গণনায়ক—এতগুলো গুণ নিয়ে বিদায় নিলেন ৮৭ বছর বয়সে।

এই জীবন দীর্ঘ হলেও এসব মানুষের জন্য এ ক্ষণকাল। শৈশব পেরিয়ে কৈশোরেই দেশভাগের বেদনা নিয়ে তখনকার পশ্চিমবঙ্গ থেকে পূর্ব পাকিস্তানের উত্তরবঙ্গের দিনাজপুরে চলে এলেন। স্কুল-কলেজের লেখাপড়া শেষে কৃষিতে যুক্ত হন। সেই থেকে ষাটের দশকে তাঁর নানা ভাবনার উদয়। শতবর্ষী দিনাজপুরের নাট্য সমিতিতে যুক্ত হয়ে নিয়মিত নাট্যক্রিয়ায় অংশ নেন, নাট্য সমিতির বাইরেও নবরূপীতেও তিনি যুক্ত হন।

অনেক নাটকে অভিনয় করে, অনুশীলনে অংশ নিয়ে দ্রুতই নাট্য শিক্ষক হয়ে ওঠেন। পাশাপাশি দুজন অত্যন্ত মেধাবী নাট্যকর্মীকে পেয়ে যান। একজন শাজাহান শাহ, অন্যজন মাজেদ রানা। একজন নাটকের সংগঠক, পরিচালক। অন্যজন অসাধারণ অভিনেতা। এমনি করে অনেক অভিনেতা-অভিনেত্রী পেয়ে যান।

সেই ষাটের দশকেই দিনাজপুর আলোড়িত হয়েছিল নাট্যচর্চায়। কাজী বোরহান এখানেই বৃত্তাবদ্ধ হননি। মুসলিম সমাজের সংস্কৃতিবিরোধী আচরণের বিরুদ্ধেও তিনি রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন ধর্মের সঙ্গে শিল্পের কোনো বিরোধ নেই। ক্রীড়ায় প্রবল আগ্রহী কাজী বোরহান নারীদের ক্রীড়ার জগতে নিয়ে আসার জন্যও সংগ্রাম শুরু করেন।

এই গরিব দেশ ব্যয়বহুল চিকিৎসার বিপরীতে তিনি প্রাকৃতিক চিকিৎসার কথা ভেবেছেন। রবীন্দ্রনাথও যেমন প্রায় সারা জীবনই প্রাকৃতিক চিকিৎসা এবং হোমিওপ্যাথির চর্চা করেছেন। কাজী বোরহানও ব্রতী হয়েছিলেন সেই পথে। তিনি প্রথাগত শিক্ষক ছিলেন না, কিন্তু স্বতঃস্ফূর্তভাবেই হয়ে উঠেছিলেন ‘স্যার’। ক্লাসরুমের স্যারের সীমাবদ্ধতা আছে।

কিন্তু এ রকম স্যারের কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। অজস্র, অসংখ্য তাঁর ছাত্র। এ রকম ‘স্যার’ তখনো বিরল ছিলেন, এখন আরও বিরল। এ রকম একটা প্রজাতি দ্রুতই বিলীন হতে চলেছে।
দিনাজপুর একদা ছিল বিশাল এক জেলা। রেডক্লিফ এই জেলাটাকেই দ্বিখণ্ডিত করে দিল। দিনাজপুর নামেই ভারতের পশ্চিমবঙ্গে আরেকটি জেলা রইল।

মাঝখানে হিলি সীমান্ত। ওপারে বালুরঘাট। সম্প্রতি সেই দিনাজপুর ভেঙে হয়েছে আরও এক দিনাজপুর। বাংলার সংস্কৃতি অখণ্ড হলেও মাঝখানে প্রহরারত সীমান্তরক্ষী বাহিনী। এর মধ্যেই সংস্কৃতির অখণ্ডতা রক্ষার যাঁরা অভিভাবক, তাঁদের মধ্যে কাজী বোরহান অন্যতম। পাকিস্তানের ২৪ বছর সংস্কৃতিকে ভাঙার এবং ইসলামি তমদ্দুনকে রক্ষার বিরুদ্ধে আমাদের সবাইকে লড়াই করতে হয়েছে। যার পথ ধরেই মুক্তিযুদ্ধের পর আত্মপরিচয়ে শক্তি অর্জন করে অস্ত্র পরিত্যাগ করে শিল্পের একটি বড় জায়গা হলো নাটক।

ঢাকার সমান্তরালে দিনাজপুরের নাট্যচর্চা একটি বিশিষ্ট জায়গা হয়ে দাঁড়াল। এই বাংলা নাটকের ইতিহাস বলতে বোঝায় ১৯৭২-এ কিছু মুক্তিযোদ্ধার কলকাতায় নাটক দেখা থেকেই নাকি এর সূচনা। এটা যে কত বড় ভুল, তার প্রমাণ কাজী বোরহান, শাজাহান শাহ, মাজেদ রানা।

শতবর্ষের বেশি সময় ধরে এই বাংলাতেও নাট্যচর্চা হয়েছে।

একটা বিশাল নাট্যপ্রেমী দর্শকও ছিল আর চর্চার ক্ষেত্রেও একটা বড় নাট্যকর্মী দলও এখানে অনিয়মিত হলেও নাট্যচর্চায় রত ছিল। কাজী বোরহানের মতো মানুষেরা সমাজের কাছেও গ্রহণযোগ্য শুধু নয়, শ্রদ্ধেয় করে তুলেছিলেন।

কাজী বোরহানের সঙ্গে আমার দেখা হয় সেই ৪২ বছর আগে। একটা সাইকেল ছিল তাঁর নিত্যসঙ্গী। আবার কুড়ি বছর আগে যখন দেখা হয়, তখনো সাইকেল তাঁর নিত্যসঙ্গী। একটা প্রজন্ম তখন বিশ্বাস করত ‘প্লেইন লিভিং অ্যান্ড হাই থিংকিং’। সে বাংলার এক স্বর্ণযুগ। নির্লোভ মানুষগুলো নিজেদের চিন্তা না করে ঝাঁপিয়ে পড়ত দেশের সেবায়। হয়তো আমাদেরই সৌভাগ্য হয়েছে এই সব মানুষকে দেখার, কাছাকাছি আসার।

কিন্তু কী দেশ কী হয়ে গেল! বিত্ত, অর্থ, ক্ষমতার কী দুর্দমনীয় আগ্রাসন! চারদিকে একটা লুটপাটের হিড়িক পড়ে গেল। নদী লুট হয়ে যাচ্ছে, পাহাড় লুট হয়ে যাচ্ছে, মানুষের ন্যায্য অধিকার লুট হয়ে যাচ্ছে। এই সব লুট করে আবার বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে নির্বিঘ্নে। প্রতিদিনই লুটের সংবাদ। এই সংবাদ আর কাজী বোরহানকে দেখতে-শুনতে হবে না। আমার দক্ষিণা স্যার, লতিফ স্যার, জলিল স্যারকেও দেখতে হলো না।

সবচেয়ে বড় কষ্টের জায়গা—কাজী বোরহানরা যেসব প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন, তার নিরাপত্তা দেবে কে? রাজনীতিতে কল্যাণকামিতার অবশেষও যখন থাকছে না, তখন মূল্যবোধেরও চরম বিপর্যয় ঘটেছে। কাজী বোরহানরা তখন বেঁচে ছিলেন মানুষের মূল্যবোধের পাহারাদার হিসেবে।

রবীন্দ্রনাথ সভ্যতার সংকটে হতাশা ব্যক্ত করেছেন। বিদ্যাসাগরের শেষ জীবনও অনিশ্চিত বেদনার মধ্য দিয়ে গেছে। সে ক্ষেত্রে বলতে হবে, কাজী বোরহানের শেষ জীবনে একটা আশ্রয় ছিল তাঁর পরিবার; পরম স্নেহে, মমতায় এবং পরিচর্যায় কেটেছে তাঁর মেয়ে বন্যার কাছে। অন্য মেয়েরাও তাঁর সঙ্গী হয়েছে। তিনি পরিবারকে গুরুত্ব দিতেন। মেয়েটি সু-অভিনেত্রী ছিলেন। এটা তাঁর ভাগ্য নয়, এভাবেই তিনি তৈরি করেছিলেন তাঁর পরিবার। তিনি শেষ জীবনে এসে কিছু পুরস্কার পেয়েছেন। সেগুলোকে তিনি তাঁর নিষ্ঠার ফল বলেই বিবেচনা করতেন।

মাত্র কয়েক দিন আগেই তিনি আমাদের ‘কল্যাণী’ নাটক দেখতে এসেছিলেন। নাটক শেষে আমি মঞ্চ থেকে নেমে একজন শ্রদ্ধেয় অভিনেতার সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। তিনি উষ্ণ করমর্দন করে বলেন, ‘আপনারা তো বলছেন আজকের এই মুহূর্তে, কিন্তু অনাগত ভবিষ্যতে এই সত্যের পরিবর্তন হবে। কারণ, সত্য নিয়ত পরিবর্তনশীল।’ কিন্তু সেদিন কাজী বোরহানের মতো আমরা কেউ থাকব না। তবে পরিবর্তন আসুক, প্রচণ্ড খরার পর যেমন প্রশান্তির বৃষ্টি নামে, তেমনি নামুক। কাজী বোরহানকে আমাদের আজ কিছুই দেওয়ার নেই। তবে টিনের তলোয়ার উঁচিয়ে তাঁকে জানাই লাল সালাম।

লেখক: মামুনুর রশীদ, নাট্যব্যক্তিত্ব

Published by

Natok@Sm

দিনাজপুর নাট্য সমিতি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *