কাজী বোরহান উদ্দীন এর শোকসভা দিনাজপুর নাট্য সমিতি
দিনাজপুর নাট্য সমিতির নাট্যাধ্যক্ষ, শিল্পকলা পদকপ্রাপ্ত সর্বজন শ্রদ্ধেয় নাট্যজন কাজী বোরহন উদ্দীন – এর
শোকসভা
১৩ আষাঢ় ১৪৩১, ২৭ জুন ২০২৪
বৃহস্পতিবার, সন্ধ্যা সাড়ে ৭:০০টায়
দিনাজপুর নাট্য সমিতি গৃহে
কাজী বোরহান: দিনাজপুর ছাড়িয়ে তিনি সর্বত্র
দিনাজপুরের কাজী বোরহান লোকান্তরিত হলেন। একজন নাট্য শিক্ষক, উঁচু মানের অভিনেতা, কৃষিবিজ্ঞানী, ক্রীড়াবিদ, বিশেষ করে নারীদের ক্রীড়ায় যুক্ত করার উদ্যোক্তা, শিক্ষায় অগ্রণী ভূমিকা, প্রাকৃতিক চিকিৎসায় আগ্রহী এবং মানুষ হিসেবে আজীবন সংগ্রামী এক গণনায়ক—এতগুলো গুণ নিয়ে বিদায় নিলেন ৮৭ বছর বয়সে।
এই জীবন দীর্ঘ হলেও এসব মানুষের জন্য এ ক্ষণকাল। শৈশব পেরিয়ে কৈশোরেই দেশভাগের বেদনা নিয়ে তখনকার পশ্চিমবঙ্গ থেকে পূর্ব পাকিস্তানের উত্তরবঙ্গের দিনাজপুরে চলে এলেন। স্কুল-কলেজের লেখাপড়া শেষে কৃষিতে যুক্ত হন। সেই থেকে ষাটের দশকে তাঁর নানা ভাবনার উদয়। শতবর্ষী দিনাজপুরের নাট্য সমিতিতে যুক্ত হয়ে নিয়মিত নাট্যক্রিয়ায় অংশ নেন, নাট্য সমিতির বাইরেও নবরূপীতেও তিনি যুক্ত হন।
অনেক নাটকে অভিনয় করে, অনুশীলনে অংশ নিয়ে দ্রুতই নাট্য শিক্ষক হয়ে ওঠেন। পাশাপাশি দুজন অত্যন্ত মেধাবী নাট্যকর্মীকে পেয়ে যান। একজন শাজাহান শাহ, অন্যজন মাজেদ রানা। একজন নাটকের সংগঠক, পরিচালক। অন্যজন অসাধারণ অভিনেতা। এমনি করে অনেক অভিনেতা-অভিনেত্রী পেয়ে যান।
সেই ষাটের দশকেই দিনাজপুর আলোড়িত হয়েছিল নাট্যচর্চায়। কাজী বোরহান এখানেই বৃত্তাবদ্ধ হননি। মুসলিম সমাজের সংস্কৃতিবিরোধী আচরণের বিরুদ্ধেও তিনি রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন ধর্মের সঙ্গে শিল্পের কোনো বিরোধ নেই। ক্রীড়ায় প্রবল আগ্রহী কাজী বোরহান নারীদের ক্রীড়ার জগতে নিয়ে আসার জন্যও সংগ্রাম শুরু করেন।
এই গরিব দেশ ব্যয়বহুল চিকিৎসার বিপরীতে তিনি প্রাকৃতিক চিকিৎসার কথা ভেবেছেন। রবীন্দ্রনাথও যেমন প্রায় সারা জীবনই প্রাকৃতিক চিকিৎসা এবং হোমিওপ্যাথির চর্চা করেছেন। কাজী বোরহানও ব্রতী হয়েছিলেন সেই পথে। তিনি প্রথাগত শিক্ষক ছিলেন না, কিন্তু স্বতঃস্ফূর্তভাবেই হয়ে উঠেছিলেন ‘স্যার’। ক্লাসরুমের স্যারের সীমাবদ্ধতা আছে।
কিন্তু এ রকম স্যারের কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। অজস্র, অসংখ্য তাঁর ছাত্র। এ রকম ‘স্যার’ তখনো বিরল ছিলেন, এখন আরও বিরল। এ রকম একটা প্রজাতি দ্রুতই বিলীন হতে চলেছে।
দিনাজপুর একদা ছিল বিশাল এক জেলা। রেডক্লিফ এই জেলাটাকেই দ্বিখণ্ডিত করে দিল। দিনাজপুর নামেই ভারতের পশ্চিমবঙ্গে আরেকটি জেলা রইল।
মাঝখানে হিলি সীমান্ত। ওপারে বালুরঘাট। সম্প্রতি সেই দিনাজপুর ভেঙে হয়েছে আরও এক দিনাজপুর। বাংলার সংস্কৃতি অখণ্ড হলেও মাঝখানে প্রহরারত সীমান্তরক্ষী বাহিনী। এর মধ্যেই সংস্কৃতির অখণ্ডতা রক্ষার যাঁরা অভিভাবক, তাঁদের মধ্যে কাজী বোরহান অন্যতম। পাকিস্তানের ২৪ বছর সংস্কৃতিকে ভাঙার এবং ইসলামি তমদ্দুনকে রক্ষার বিরুদ্ধে আমাদের সবাইকে লড়াই করতে হয়েছে। যার পথ ধরেই মুক্তিযুদ্ধের পর আত্মপরিচয়ে শক্তি অর্জন করে অস্ত্র পরিত্যাগ করে শিল্পের একটি বড় জায়গা হলো নাটক।
ঢাকার সমান্তরালে দিনাজপুরের নাট্যচর্চা একটি বিশিষ্ট জায়গা হয়ে দাঁড়াল। এই বাংলা নাটকের ইতিহাস বলতে বোঝায় ১৯৭২-এ কিছু মুক্তিযোদ্ধার কলকাতায় নাটক দেখা থেকেই নাকি এর সূচনা। এটা যে কত বড় ভুল, তার প্রমাণ কাজী বোরহান, শাজাহান শাহ, মাজেদ রানা।
শতবর্ষের বেশি সময় ধরে এই বাংলাতেও নাট্যচর্চা হয়েছে।
একটা বিশাল নাট্যপ্রেমী দর্শকও ছিল আর চর্চার ক্ষেত্রেও একটা বড় নাট্যকর্মী দলও এখানে অনিয়মিত হলেও নাট্যচর্চায় রত ছিল। কাজী বোরহানের মতো মানুষেরা সমাজের কাছেও গ্রহণযোগ্য শুধু নয়, শ্রদ্ধেয় করে তুলেছিলেন।
কাজী বোরহানের সঙ্গে আমার দেখা হয় সেই ৪২ বছর আগে। একটা সাইকেল ছিল তাঁর নিত্যসঙ্গী। আবার কুড়ি বছর আগে যখন দেখা হয়, তখনো সাইকেল তাঁর নিত্যসঙ্গী। একটা প্রজন্ম তখন বিশ্বাস করত ‘প্লেইন লিভিং অ্যান্ড হাই থিংকিং’। সে বাংলার এক স্বর্ণযুগ। নির্লোভ মানুষগুলো নিজেদের চিন্তা না করে ঝাঁপিয়ে পড়ত দেশের সেবায়। হয়তো আমাদেরই সৌভাগ্য হয়েছে এই সব মানুষকে দেখার, কাছাকাছি আসার।
কিন্তু কী দেশ কী হয়ে গেল! বিত্ত, অর্থ, ক্ষমতার কী দুর্দমনীয় আগ্রাসন! চারদিকে একটা লুটপাটের হিড়িক পড়ে গেল। নদী লুট হয়ে যাচ্ছে, পাহাড় লুট হয়ে যাচ্ছে, মানুষের ন্যায্য অধিকার লুট হয়ে যাচ্ছে। এই সব লুট করে আবার বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে নির্বিঘ্নে। প্রতিদিনই লুটের সংবাদ। এই সংবাদ আর কাজী বোরহানকে দেখতে-শুনতে হবে না। আমার দক্ষিণা স্যার, লতিফ স্যার, জলিল স্যারকেও দেখতে হলো না।
সবচেয়ে বড় কষ্টের জায়গা—কাজী বোরহানরা যেসব প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন, তার নিরাপত্তা দেবে কে? রাজনীতিতে কল্যাণকামিতার অবশেষও যখন থাকছে না, তখন মূল্যবোধেরও চরম বিপর্যয় ঘটেছে। কাজী বোরহানরা তখন বেঁচে ছিলেন মানুষের মূল্যবোধের পাহারাদার হিসেবে।
রবীন্দ্রনাথ সভ্যতার সংকটে হতাশা ব্যক্ত করেছেন। বিদ্যাসাগরের শেষ জীবনও অনিশ্চিত বেদনার মধ্য দিয়ে গেছে। সে ক্ষেত্রে বলতে হবে, কাজী বোরহানের শেষ জীবনে একটা আশ্রয় ছিল তাঁর পরিবার; পরম স্নেহে, মমতায় এবং পরিচর্যায় কেটেছে তাঁর মেয়ে বন্যার কাছে। অন্য মেয়েরাও তাঁর সঙ্গী হয়েছে। তিনি পরিবারকে গুরুত্ব দিতেন। মেয়েটি সু-অভিনেত্রী ছিলেন। এটা তাঁর ভাগ্য নয়, এভাবেই তিনি তৈরি করেছিলেন তাঁর পরিবার। তিনি শেষ জীবনে এসে কিছু পুরস্কার পেয়েছেন। সেগুলোকে তিনি তাঁর নিষ্ঠার ফল বলেই বিবেচনা করতেন।
মাত্র কয়েক দিন আগেই তিনি আমাদের ‘কল্যাণী’ নাটক দেখতে এসেছিলেন। নাটক শেষে আমি মঞ্চ থেকে নেমে একজন শ্রদ্ধেয় অভিনেতার সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। তিনি উষ্ণ করমর্দন করে বলেন, ‘আপনারা তো বলছেন আজকের এই মুহূর্তে, কিন্তু অনাগত ভবিষ্যতে এই সত্যের পরিবর্তন হবে। কারণ, সত্য নিয়ত পরিবর্তনশীল।’ কিন্তু সেদিন কাজী বোরহানের মতো আমরা কেউ থাকব না। তবে পরিবর্তন আসুক, প্রচণ্ড খরার পর যেমন প্রশান্তির বৃষ্টি নামে, তেমনি নামুক। কাজী বোরহানকে আমাদের আজ কিছুই দেওয়ার নেই। তবে টিনের তলোয়ার উঁচিয়ে তাঁকে জানাই লাল সালাম।
কাজী বোরহান উদ্দীনকে সংবর্ধনা
নাট্যকলায় সামগ্রিক অবদানের জন্য শিল্পকলা পদক-২০১৫ পাওয়ায় দিনাজপুরবাসীর পক্ষ থেকে অধ্যক্ষ কাজী বোরহান উদ্দীনকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছে। দিনাজপুর নাট্য সমিতি মঞ্চে গত বুধবার রাতে বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং শতাধিক শিল্পী তাঁকে ওই সংবর্ধনা দেন।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন নাট্য সমিতি ও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি মির্জা আনোয়ারুল ইসলাম। অনুষ্ঠানে দিনাজপুরের নাট্যাঙ্গনে কাজী বোরহান উদ্দিনের ভূমিকা এবং তাঁর অভিনয় নিয়ে আলোচনা করেন নবরূপীর সাধারণ সম্পাদক শাহাজাহান শাহ।
শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন নাগরিক উদ্যোগের সভাপতি আবুল কালাম আজাদ, নাট্য সমিতির সাধারণ সম্পাদক রেজাউর রহমান, উদীচী জেলা সংসদের সাধারণ সম্পাদক সত্য ঘোষ, মহিলা পরিষদের সভাপতি কানিজ রহমান, কলেজিয়েট গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ হাবিবুল ইসলাম, গবেষক মাসুদুল হক, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সাধারণ সম্পাদক সুলতান কামাল উদ্দিন, রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী নূরুল মতিন, জেলা কালচারাল অফিসার মো. আসফউদ্দৌলা, সাংস্কৃতিক কর্মী ময়েন উদ্দিন চিশতি, সাংস্কৃতিক সংগঠন ভৈরবীর সাধারণ সম্পাদক মো. রহমতুল্লাহ প্রমুখ।
সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে কাজী বোরহান উদ্দিন বলেন, ‘দেশে ধর্মান্ধতা, মৌলবাদী অপশক্তিকে রুখতে হলে সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোকে দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখতে হবে।
যত দিন বেঁচে থাকব, নাটকের সঙ্গেই থাকতে চাই।’ তিনি দিনাজপুরের বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতা-কর্মীদের দৃঢ়তার সঙ্গে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার আহ্বান জানান।
প্রসঙ্গত, গত ৫ মে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ তাঁর হাতে শিল্পকলা পদক-২০১৫ তুলে দেন।
‘শিল্পকলা পদক’ পেল শতবর্ষী প্রতিষ্ঠান দিনাজপুর নাট্য সমিতি
সৃজনশীল সাংস্কৃতিক সংগঠন হিসেবে ‘শিল্পকলা পদক’-২০২০ পেয়েছে দিনাজপুরের ঐতিহ্যবাহী শতবর্ষী প্রাচীন নাট্য প্রতিষ্ঠান দিনাজপুর নাট্য সমিতি। এছাড়া দেশের শিল্প-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে জাতীয় পর্যায়ে বিশেষ অবদানের জন্য বাংলাদেশ শিল্পকলা অ্যাকাডেমির উদ্যোগে ১৮ গুনী ও ২ সংগঠনকে ‘শিল্পকলা পদক ২০১৯ ও ২০২০’ প্রদান করা হয়।
গত ২২ সেপ্টেম্বর ঢাকায় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালা মিলানয়তনে এই পদক প্রদান করা হয়। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে ভার্চুয়ালি উপস্থিত ছিলেন রাষ্ট্রপতি জনাব মো. আবদুল হামিদ। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, এমপি এবং সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আবুল মনসুর। সভাপতিত্ব করেন সংস্কৃতিবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী কে.এম খালিদ এবং স্বাগত বক্তব্য প্রদান করেন অ্যাকাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী।
অনুষ্ঠানে সভাপতি সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ এর হাত হতে দিনাজপুর নাট্য সমিতিকে দেয়া পদক গ্রহন করেন নাট্য সমিতির সভাপতি চিত্ত ঘোষ।
উল্লেখ্য, দেশের শিল্প-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে জাতীয় পর্যায়ে বিশেষ অবদানের জন্য গুণীজনদের অবদানকে সম্মান ও স্বীকৃতি জানাতে বাংলাদেশ শিল্পকলা অ্যাকাডেমির উদ্যোগে ২০১৩ সাল থেকে ‘শিল্পকলা পদক’ প্রদান করা হয়। করোনা মহামারীর কারণে ‘শিল্পকলা পদক’ এর অনুষ্ঠান স্থগিত থাকায় এ বছর ২০১৯ ও ২০২০ দু’বছর এর পদক একসঙ্গে প্রদান করা হয়। ২০১৯ সালে একটি সংগঠনসহ দশজন ও ২০২০ সালে একটি সংগঠনসহ দশজন করে মোট বিশ জনকে এ পদক প্রদান করা হয়।
উনিশ শতকের শেষ প্রান্তে মঞ্চ নাটক চর্চার প্রাণকেন্দ্র কলকাতার ঢেউ দিনাজপুরকেও আন্দোলিত করে। ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দের ৭ ডিসেম্বর প্রথম নাটক ‘জয়দ্রথ’ অভিনীত হয় দিনাজপুরের রথের মাঠে। ১৮৮৫ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে দিনাজপুরে ‘ডায়মন্ড জুবিলী থিয়েটার’ কোম্পানি গঠিত হয়। ১৯০৪ সালে দিনাজপুর শহরের মধ্যস্থলে ক্ষেত্রীপাড়ায় প্রধানত দিনাজপুরের নাট্য আন্দোলনের অগ্রদূত বিশিষ্ট মঞ্চাভিনেতা ও নাট্যকার শ্রী হরিচরণ সেনের উদ্যোগে ‘ডায়মন্ড জুবিলী থিয়েটার’ হল স্থাপিত হয়। পরবর্তীকালে প্রাইভেট থিয়েটার রূপান্তরিত হয় শৌখিন নাট্যচর্চায়। কিন্তু এটির স্থায়িত্ব বেশি দিন হয়নি। এটি চলাকালে নাট্যমোদিদের মতের অমিল ঘটে এবং ১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দের ২১ জুন প্রায় ২৬ দশমিক ২৫ শতাংশ ভুমির উপর স্থাপিত হয় ‘ দিনাজপুর নাট্য সমিতি ‘।
অবিভক্ত দিনাজপুর জেলার বালিয়াডাঙ্গী থানার শাহবাজপুর গ্রামের নিবাসী শ্রীযুক্ত বসন্ত কুমার দাস-এর দুই পুত্র শ্রীযুক্ত ভবানী কুমার দাস ও শ্রীযুক্ত শিশির কুমার দাস এবং এক কন্যা শ্রীমতি কাঞ্চন মনি চৌধুরানী (স্বামী শ্রীযুক্ত পতিমাধব চৌধুরী, সাকিনÑ মুকুরিয়া, ডাকঘরÑ বারসঁই ঘাট, জেলা পূর্ণীয়া,বিহার।) তাঁদের নামীয় ওই পরিমান ভুমি দিনাজপুর নাট্য সমিতি’র নামে দান করেন।
দিনাজপুর নাট্য সমিতির প্রধান পৃষ্ঠপোষকতা করেন গুদড়ীবাজারের (বর্তমানে চকবাজার নামে পরিচিত) নাট্যপ্রিয় জমিদার রাধা গোবিন্দ রায় চৌধুরী। এ ছাড়াও এর প্রতিষ্ঠায় ভূপাল চন্দ্র সেনেরও অগ্রণী ভূমিকা ছিল। দিনাজপুরের মহারাজা জগদীশ নাথ রায়, ডাক্তার যামিনী সেন, নিশিকান্ত রায় চৌধুরী, গিরিজা মোহন নিয়োগী, মীর হামাত হোসেন প্রমুখের সহযোগিতায় ‘চন্দ্রগুপ্ত’ নাটকের মঞ্চায়নের মাধ্যমে দিনাজপুর নাট্য সমিতির প্রথম যাত্রা শুরু হয়। কুলোদ বাবু, কুনুবাবু, বিভূতি চাঁদ, হিরণ¥য় বাবু প্রমুখ সে সময় দিনাজপুর নাট্য সমিতি প্রযোজিত বিভিন্ন নাটকে স্ত্রী চরিত্রে অভিনয় করে নাট্যাঙ্গনে বেশ সুনাম অর্জন করেন।
বিশের দশকে নাট্য সমিতির গুণগত পরিবর্তন ঘটতে শুরু করে। তখন থেকে দিনাজপুর নাট্য সমিতি বিত্তবানদের অনুদান ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে এবং ক্রমশ দর্শকবৃন্দের ওপর নির্ভরশীল হয়ে ওঠে। এ সময় হতে পৃষ্ঠপোষকদের ভূমিকায় জমিদার শ্রেণির উপস্থিতি ধীরে ধীরে লুপ্ত এবং পাশাপাশি নাটকের টিকিট বিক্রি শুরু হয়। একই সময়ে দিনাজপুর নাট্য সমিতি মঞ্চে প্রফুল্ল, রাজা হরিশ চন্দ্র, শাহজাহান, মহারাজা নন্দ কুমার, শ্রী দূর্গা, কর্ণাজ্জুন, রানা প্রতাপাদিত্য, কেদার রায়, আলমগীর, ফুল্লরা, মণীষা, প্রফুল্ল প্রভৃতি সামাজিক, পৌরাণিক ও ঐতিহাসিক নাটকের অনুপ্রবেশ ঘটে। কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, সাহিত্যিক তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়, নাট্য ব্যক্তিত্ব মন্মথ রায়, চলচ্চিত্রকার রাজেন তরফদার, নটরাজ শিব প্রসাদ কর, জাদু সম্রাট পি.সি. সরকার (প্রতুল চন্দ্র সরকার), জনপ্রিয় চিত্রনায়ক রহমান, সুভাষ দত্ত (পটলা) সহ নাট্যকারদের স্মৃতিধন্য এই নাট্য সমিতি।
দিনাজপুরে নাট্য আন্দোলনের গুণিজনদের অন্যতম ছিলেন দিনাজপুর রঙ্গমঞ্চের প্রবাদ পুরুষ শিব প্রসাদ কর ও দিনাজপুর নাট্যাভিনয়ের জনক হরি চরণ সেন। ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দে তারাশংকরের ‘দুই পুরুষ’ উপন্যাসের নাট্যরূপ দেন শিবপ্রসাদ কর। ‘দুই পুরুষ’ নাটকটির আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে দিনাজপুরের নাট্য সমিতিতে নাটক দেখতে আসেন সাহিত্যিক ও উপন্যাসিক তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়। রঙ্গমঞ্চ ও নাট্য পরিচালনার কর্ণধার ছিলেন শিব প্রসাদ কর। দিনাজপুরে নাট্য অভিনয়ের সাথে একটানা ৩৫ বছর নাট্য সমিতি মঞ্চে সুদক্ষ সারথীর ভূমিকায় তাঁর নিরলস অবদান ছিল দু’যুগেরও বেশি। নাট্য সমিতির সমৃদ্ধির যুগে ১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত নাট্য সমিতির মঞ্চায়িত নাটকের মধ্যে মন্যু রায়ের চাঁদ সওদাগর, সীতা, সাবিত্রী ও খনা নাটক এবং শরৎচন্ত্রের উপন্যাস অবলম্বনে নাট্য রূপায়িত বৈকুন্ঠের উইল, মহেষ, রামের সুমতি ছাড়াও পৌরাণিক নাটক স্বর্ণলতা, ঐতিাসিক নাটক রানা রনজিৎ সিংহ, সিরাজ উদ্দৌলা, টিপু সুলতান, শাহজাহান, আলমগীর, হায়দার আলী নিয়মিতভাবে দিনাজপুর নাট্য সমিতি মঞ্চে সাফল্যের সঙ্গে মঞ্চস্থ হয়েছে।
১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে দেশ বিভাগের পর পাঁচ বছর দিনাজপুর নাট্য সমিতি নিষ্প্রভ থাকে। এর পরবর্তী সময়ে নাট্য সমিতিতে একে একে অভিনীত হয়েছে ঐতিহাসিক নাটক মিশর কুমারী, মীর কাশিম (মনাথ রায়), সিরাজ উদ্দৌলা (শচীন্দ্রনাথ সেন গুপ্ত), টিপু সুলতান (মহেন্দ্রগুপ্ত), শাহজাহান (দ্বিজেন্দ্র লাল রায়), সামাজিক নাটক কালিন্দী (তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়), মাটির ঘর (বিধায়ক ভট্টাচার্য), দুই পুরুষ (তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়) এবং হাস্যরসাত্মক নাটক ‘তাইতো’ প্রভৃতি। ১৯০৪ খ্রিষ্টাব্দে সম্ভবত দিনাজপুর নাট্য সমিতি প্রযোজিত এবং আলী মনসুর রচিত ‘পোড়াবাড়ী’ নাটকটিতে প্রথম মুসলিম মহিলা শিল্পীর আবির্ভাব ঘটে। এ ছাড়া প্রখ্যাত অনুষ্ঠান সংগঠক শ্যামা ব্যানার্জির তত্ত্বাবধানে শ্যামলী নাটকটি অভিনীত হয় যেখানে কেবল মাত্র মহিলা শিল্পীগণ সকল নাট্য চরিত্রে অভিনয় করেন।
ষাটের দশকে নাট্য সমিতি মঞ্চে অভিনীত নাটকের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো কলির জীন (তাজ মিলুর রহমান, ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দ), এরাও মানুষ (সন্তোষ সেন, ১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দ) কাঞ্চন রঙ্গ (শম্ভু মিত্র ও অমৃত মৈত্র, ১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দ) বৌদির বিয়ে, লবণাক্ত, মরাস্রোত, কুহকিনী, ফিংগার প্রিন্ট ইত্যাদি।
১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে দিনাজপুর নাট্য সমিতি প্রতি বছর আন্তঃজেলা নাট্যোৎসব ও অভিনয় প্রতিযোগিতা শুরু করে। এই নাট্যোৎসব থেকে সমিতি নিয়মিত দর্শনীর বিনিময়ে নাটক মঞ্চস্থ করে আসছে। এর ফলে নতুন নাট্য গোষ্ঠীর সৃষ্টি, নাট্যচর্চার গতিশীলতা বৃদ্ধি এবং বিভিন্ন নাট্য গোষ্ঠীর মধ্যে ভাবের আদান প্রদানের মাধ্যমে নাট্যচর্চার মান উন্নয়নের ক্ষেত্রে এই প্রতিযোগিতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে নাট্য সমিতিতে প্রচুর নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে। ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে দিনাজপুর নাট্য সমিতি ময়মনসিংহ আন্তঃজেলা নাট্যোৎসবে ‘ভূমিকম্পের পরে’ নাটকটি মঞ্চায়নের মাধ্যমে প্রতিযোগিতায় ঘোষিত ১১ টির মধ্যে ৯টি পুরস্কার লাভ করে। ভূমিকম্পের আগে, বাকী ইতিহাস, অমৃতস্য পুত্র, এই দশকের মঞ্চে, সম্রাট, ভূমিকম্পের পরে, সুবচন নির্বাসনে, উল্কা, ভেঁপুতে বেহাগ, ফিংগার প্রিন্ট, অন্ধকারের নীচে সূর্য, ভাড়াটে চাই, ক্যাপ্টেন হুররা, আলিবাবা, কুহকিনী, সেনাপতি, যদিও সন্ধ্যা, নতুন মানুষ, ক্ষত বিক্ষত, পাহাড়ী ফুল, তৃতীয় পুরুষ, এখনও ক্রীতদাস, তোমরাই, দ্যাশের মানুষ, হিসাবের খাতা, দেওয়ান গাজীর কিসসা, মাগানা সওয়ারী, কেনা রাম বেচারাম, একাত্তরের পালা, এই রোদ এই বৃষ্টি, মানুষ, নৈশ ভোজ, স্পধা, ঝিঁঝিঁ পোকার কান্না, হত্যারে প্রভৃতি আরো অনেক নাটক।
পরবর্তী সময়ে সংস্থাটির আত্মবিকাশ ও উন্নতি সাধনের ভূমিকায় যাদের সহযোগিতা অবিচ্ছিন্ন তারা হলেন- কাজী বোরহান, মকবুল মোক্তার (প্রয়াত), গুরুদাশ তালুকদার (প্রয়াত), আদল সরকার (প্রয়াত), ডা. হাফিজ উদ্দীন (প্রয়াত), নিত্য গোপাল, কমলেশ দা (প্রয়াত), মনুদা (প্রয়াত), তালেব ভাই (প্রয়াত), আকবর আলী ঝুনু (প্রয়াত), শাহ রহমত বাবু ভাই (প্রয়াত), মির্জা আনোয়ারুল ইসলাম তানু (প্রয়াত), মোহন কুমার দাশ (প্রয়াত) প্রমুখ।
২০১৩ খ্রিষ্টাব্দের দিনাজপুর নাট্য সমিতির শতবর্ষ পূর্তি হয়েছে। ২০১৫ খ্রিস্টাব্দের ২৯ অক্টোবর থেকে ২১ নভেম্বর পর্যন্ত নাট্য সমিতির একবিংশ নাট্যোৎসব শুরু হয়েছিল। নাট্য সমিতি যামিনীর শেষ সংলাপ নাটকটির মধ্যদিয়ে নাটকের শতবর্ষ পূর্তি ও একবিংশ দিনাজপুর নাট্যোৎসব শুরু করেছিল। এরপর ’আতর আলীর নীলাভ পাট’, ’সাদা কাগজ’ ’কনক সরোজিনী’ ‘নন্দিনীর পালা’ সহ ১০টি নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে শতাধিক বর্ষী প্রাচীন দিনাজপুর নাট্য সমিতির মঞ্চে।
দিনাজপুর নাট্য সমিতির শতবর্ষপূর্তি ও নাট্যোৎসব লিফলেট
দিনাজপুর নাট্য সমিতির শতবর্ষপূর্তি ও নাট্যোৎসব লিফলেট
শতবর্ষের ঐতিহ্যে দিনাজপুর নাট্য সমিতি
দিনাজপুর নাট্য সমিতি ১৯১৩ খ্রি. প্রতিষ্ঠিত একটি নাট্যশালা। সে হিসেবে বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির বয়স একশত নয় বছর। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি এই প্রতিষ্ঠানকে বাংলাদেশের অন্যতম শতবর্ষী নাট্যমঞ্চ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। স্বাধীনভাবে থিয়েটার চর্চার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠানটি শতবর্ষ আগে তৎকালীন মহারাজা গিরিজানাথ রায় এর সরাসরি তত্ত্বাবধানে যাত্রা শুরু করেছিল। বাংলার বহু উল্লেখযোগ্য সাহিত্য-সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় দিনাজপুর নাট্যসমিতির এই দীর্ঘ যাত্রাপথে বিভিন্নভাবে বিভিন্ন মাত্রায় সংযুক্ত হয়েছিলেন এই প্রতিষ্ঠানের সাথে। বিশেষ করে নাট্যকার মন্মথ রায়, বিপিন চন্দ্র পাল, মুকুন্দ দাস, পি.সি সরকার, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়, কুমার রায়, শিবপ্রসাদ কর, এম.আর আক্তার মুকুল, নিতুন কুন্ডু, সুভাষ দত্ত, রাজেন তরফদার, রামেন্দ্র মজুমদার, আবদুল্লাহ আল মামুন, কামাল লোহানী, সৈয়দ হাসান ইমাম, আলী যাকের, সারা যাকের, মামুনুর রশিদ, আসাদুজ্জামান নূর, ড. গওহর রিজভী, শ্যামল সেন গুপ্ত, চন্দন সেন, মো: লিয়াকত আলী লাকী প্রমুখ উজ্জ্বলতম ব্যক্তিত্বের স্পর্শে ধন্য হয়েছে দিনাজপুর নাট্য সমিতি শতবর্ষ জুড়ে।
১৯১৩ খ্রি. ডায়মন্ড জুবিলি থিয়েটারের শিল্পীদের মতবিরোধকে কেন্দ্র করে প্রায় রাতারাতি গোলকুঠি বাহাদুর বাজার এলাকায় গড়ে ওঠে একটি নতুন নাট্যশালা- ‘দিনাজপুর ড্রামাটিক হল‘। যাদের সক্রিয় উদ্যোগে এই নাট্যশালাটি প্রতিষ্ঠা পায় তারা হলেন নিশিকান্ত চৌধুরী, ভূপাল চন্দ্র সেনগুপ্ত, গিরিজামোহন নিয়োগী, ভবানী প্রসাদ চৌধুরী, ট্যাঙ্গর চক্রবর্তী, শিশির প্রসাদ চৌধুরী, নেদাবাবু, গৌরপ্রসাদ বড়াল, শরৎচন্দ্র গুপ্ত, চারুচন্দ্র সেন, অবনী নন্দী, দুখু সেন, হরিনারায়ণ চক্রবর্তী এবং আরও অনেক নেতৃস্থানীয় শিল্পী। দিনাজপুর ড্রামাটিক হল নির্মাণের জন্য ২৬.২৫ শতক জমি দান করেন শ্রীযুক্ত ভবানী কুমার দাস, শ্রীযুক্ত শিশির কুমার দাস, শ্রীমতি কাঞ্চন মনি চৌধুরাণী।
ঐ বছর ২১ জুন, রবিবার নবনির্মিত ড্রামাটিক হল নাট্যশালার দ্বারোদঘাটন করেন জেলা কালেক্টর মি. হ্যারউড। উদ্বোধনী নাটক ছিল ভূপাল সেনগুপ্ত এর পরিচালনায় ‘চন্দ্রগুপ্ত’। ১৯১৩ থেকে ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে যে সকল নাটক সাফল্যের সাথে মঞ্চস্থ হয় তার মধ্যে ‘চন্দ্রগুপ্ত’, ‘আবু হোসেন’, ‘হরিশচন্দ্র’, ‘জয়দ্রথ’, ‘প্রফুল্ল’, ‘কর্ণার্জুন’, ‘শ্রীকৃষ্ণ’, ‘উত্তরা’, ‘ফুল্লরা’, ‘সীতা’, ‘সিন্ধুবিজয়’, ‘কিন্নরি’, ‘দেবলা-দেবী’, ‘পরদেশী’, ‘শ্রীদুর্গা’, ‘বিত্রাসুর’, ‘চাঁদ সওদাগর’, ‘স্বর্ণলঙ্কা’ উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও কার্তিক গুপ্তের ‘চাণক্য’, দুখু সেনের ‘গোলাম হোসেন’, কামাখ্যানিয়োগীর ‘দিলদার’, রামাপদ দাশগুপ্তর ‘ঔরঙ্গজেব’, শচীন বোসের ‘সাজাহান’, রাধিকারমণ ভট্টাচার্যের ‘সত্যবান’ চরিত্রের অভিনয় স্মরণীয় হয়ে আছে।
দিনাজপুর নাট্য সমিতির উজ্জ্বলতম জ্যোতিষ্ক শিবপ্রসাদ কর ১৯১৪ খ্রি. ‘চাঁদ বিবি’ নাটকে একটি নারী চরিত্রে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে নাট্যমঞ্চে তাঁর আবির্ভাব ঘটে। পরবর্তীতে আরো কিছু নারী চরিত্রে অভিনয় করে ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের পর তাঁর নাট্যাঙ্গনে সৃজনশীলতার পূর্ণাঙ্গ বিকাশ ঘটে। তাঁর লেখা ‘স্বর্ণলঙ্কা’ নাটকটি মঞ্চস্থ হয় নাট্য সমিতি মঞ্চে। এরপর নাটকটি কলকাতাসহ ভারতের বিভিন্ন মঞ্চে সফলতার সাথে মঞ্চস্থ হয়। ১৯২৫ থেকে ১৯৩৫ খ্রি. মধ্যে নাট্য সমিতি মঞ্চে মঞ্চস্থ উল্লেখযোগ্য নাটকগুলো হলো ‘প্রতাপাদিত্য, ‘সাজাহান’, ‘সুলতান’, ‘পলাশীর পরে’, ‘মিশর কুমারী’, ‘দেবী চৌধুরানী’, ‘রণজিৎ সিঙ’, ‘রাজা নন্দকুমার’, ‘হায়দার আলী’, ‘টিপু সুলতান’, ‘কেদার রায়’, ‘আলমগীর’। শিবপ্রসাদ কর অসাধারণ নৈপুণ্য প্রদর্শন করেন এ সকল নাটকে অভিনয় করে। শিবু করের ‘দুই পুরুষ’ নাটকে নটু বিহারী চরিত্রে দু’রাত্রিতে দুইমাত্রার অভিনয় স্বয়ং বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক তারাশংকরকেও অভিভূত করে। শিবপ্রসাদ কর তাই দিনাজপুরের নাট্যোমোদীদের কাছে মিথ হয়ে আছেন। এই সময়ে শিব প্রসাদ করের সাথে যাঁরা মঞ্চে কৃতিত্বের সাথে অভিনয় করেছিলেন তাঁদের মধ্যে শ্রীশচন্দ্র গুপ্ত (টুনু), সুধীর চন্দ্র রায়, কালিয়া কান্ত রায়, ক্ষিতিশচন্দ্র দাশগুপ্ত, নারায়ণবন্ধু সরকার, রমাপতি বাবু, হিরন্ময় বাবু, বিভূতি চাঁদ প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। বিশের দশক থেকে নাটকে যোগ দেন সতীশচন্দ্র গুপ্ত, মণি সেন, তুলসী চাঁদ, ধীরেন্দ্র নারায়ণ ঘোষ, জিতেন মজুমদার, গুরুদাস তালুকদার, কেষ্ট নন্দী, রতন মাষ্টার, রাধিকা আইচ, সত্যপদ রায়, মনু দাশগুপ্ত, বিমল দাশগুপ্ত, অরণেন্দু নন্দী, কামাক্ষ্যা চ্যাটার্জী, হিরন্ময় ভট্টাচার্য, সুশীল সেন, মন্মথ দত্ত, অমিয় সেন, সতীশ চন্দ্র গুপ্ত প্রমুখ।
১৯৩৫ থেকে ১৯৪২ সালের মধ্যে দিনাজপুর নাট্য সমিতির মঞ্চে শুরু হয় সামাজিক নাটকের চর্চা। এ সময়ে যে সকল নাটক মঞ্চে আসে তারমধ্যে ‘বৈকুন্ঠের উইল’, ‘গোড়ায় গলদ’, ‘জনা’, ‘বিষবৃক্ষ’, ‘চির কুমার সভা’, ‘শেষ রক্ষা’, ‘পথের শেষে’, ‘দুই মানুষ’, ‘রামের সুমতি’, ‘পতিব্রতা’, ‘সাবিত্রী’, ‘ক্ষণা’ উল্লেখযোগ্য।
১৯৪২ খ্রি. পরবর্তী ভারত বিভক্তি পূর্বকাল পর্যন্ত ভারত বর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলন, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা মোকাবেলার জন্য দেশপ্রেম মূলক নাট্যচর্চার জোয়ার আসে। এ সময়ের উল্লেখযোগ্য নাটকগুলি হলো ‘বঙ্গে বর্গী’, ‘সিরাজদৌলা’, ‘নীল দর্পণ’, ‘মীর কাশিম’, ‘কারাগার’, ‘নতুন প্রভাত’, ‘কালিন্দী, ‘আলী বাবা’। ‘সিরাজদ্দৌল্লা’ চরিত্রে সতীশচন্দ্রের অভিনয় উচ্চ প্রশংসিত হয়েছিল। উল্লেখ্য যে, কিছু নতুন নাট্যপ্রতিভা এ সময় সংযুক্ত হন নাট্য সমিতির সাথে। তাদের মধ্যে প্রভাত দাশগুপ্ত (ফটিক), রাজেন তরফদার, অনাদি রায়, সুতান সরকার, সুভাষ দত্ত (পটলা) প্রমুখ।
এরপর ভারত বিভক্তির কারণে নাট্যসমিতির অভিনেতা নির্দেশক ও পৃষ্ঠপোষকদের একটা বড় অংশ ভারতে চলে যায়, ফলে অল্পদিনের জন্য নাট্য সমিতি যেন কিছুটা থমকে যায়। কিন্তু ১৯৫১-৫২ ভাষা আন্দোলন কেন্দ্রিক বাঙালির নবচেতনার উন্মেষ ঘটলে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত যেসব নাটক মঞ্চস্থ হয়, এর মধ্যে অভিনয় নয়’, ‘তাই তো’, ‘তেরোশো পঞ্চাশ’, ‘নবান্ন’, ‘মাটির মায়ানগাল শিখা’, ‘দুখীর ইমান’, ‘লবনাক্ত’, ‘কাঞ্চন রঙ্গ’, ‘বাস্তুভিটা তার’, ‘মানময়ী গার্লস স্কুল’, ‘সামন্তক মনি’, ‘দ্বীপান্তর’, ‘জীবন নাটক’, ‘উল্কা’, ‘কালের পদধ্বনি’, ‘ক্ষুধা’, ‘এরাও মানুষ’ উল্লেখযোগ্য। এ সময় নারী চরিত্রে অভিনেত্রী পাওয়া দুষ্কর ছিল তাই এই সংকট মেটাতে গুরুদাস তালুকদার, তালেব আলী, গৌরাঙ্গ বারুই, সত্যেন চক্রবর্তী, নারী চরিত্রে অভিনয় করেছেন।
ষাটের দশকের মধ্যবর্তী সময় থেকে নাট্য সমিতির সাথে সংযুক্ত হয় আরো কিছু নতুন মুখ নতুন প্রতিভা। এদের মধ্যে ডা. হাফিজ উদ্দিন, নিত্য গোপাল দাস, মকবুল হোসেন (মোক্তার), কাজী বোরহান, মির্জা আনোয়ারুল ইসলাম তানু, মতিয়ার রহমান সরকার, গুরুদাস তালুকদার, আদল সরকার, আব্দুস সাত্তার, কমলেশ ঘোষ, তালেব আলী, আকবর আলী ঝুনু প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। দিনাজপুর নাট্য সমিতি তৎকালীন সময়ে কলকাতার নবনাট্য আন্দোলনের সাথে সরাসরি যুক্ত ছিল। স্বাধীনতার পূর্ব পর্যন্ত প্রতি শনিবার সাপ্তাহিক ছুটির আগের দিন নিয়মিত নাট্য মঞ্চায়নের ঐতিহ্য ছিল দিনাজপুর নাট্য সমিতির। প্রায় প্রতিষ্ঠাকালীন সময় হতেই টিকিটের বিনিময়ে নাটক প্রদর্শনীর ঐতিহ্য অব্যাহত রেখেছে দিনাজপুর নাট্য সমিতি।
১৯৬৩ খ্রি. দিনাজপুর নাট্য সমিতির জন্য অত্যন্ত গৌরবের বছর। কেননা ঐ বছর তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানে প্রথম মাসব্যাপী নাট্যোৎসব ও প্রতিযোগিতার আয়োজন করে দিনাজপুর নাট্য সমিতি যা বাঙালি নাট্যচর্চার একটি মাইলফলক হিসেবে ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে। এরপর মহান মুক্তিযুদ্ধের কারণে দিনাজপুর নাট্য সমিতির কর্মকাণ্ড বন্ধ থাকে। এ সময় অভিনেতা, নাট্যকার, নির্দেশক প্রায় সকলেই মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ে। সারাদেশের মতো নাট্য সমিতিকেও পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী জ্বালিয়ে দেয়। ফলে নাট্য সমিতির গুরুত্বপূর্ণ দলিল, নথি- কাগজপত্র ও নাটকের সেট-প্রপস পুড়ে যায়। তাই নাট্য সমিতির পূর্বের কোনো ঐতিহাসিক দলিল ও নিদর্শন খুঁজে পাওয়া যায় না। এমতাবস্থায় মুক্তিযুদ্ধোত্তরকালে পুনরায় শক্ত হাতে হাল ধরে নাট্য সমিতিকে পুনর্গঠন করেন কাজী বোরহান, মির্জা আনোয়ারুল ইসলাম তানু, আব্দুস সাত্তার, সরদার মোশাররফ হোসেন, শাজাহান শাহ, আদল সরকার, সফি মকসুদ নূরু প্রমুখ। তারা নাট্য সমিতির অবকাঠামো উন্নয়নসহ নাটক মঞ্চায়নে বড় ভূমিকা রাখেন। আবারও শুরু হয় নাটক মঞ্চায়ন ও মাসব্যাপী নাট্যোৎসব ও প্রতিযোগিতা।
১৯৭১ থেকে ২০০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে যে নাটকগুলো মঞ্চস্থ হয় তার মধ্যে ‘কিংশুক যে মরুতে’, ‘সম্রাট’, ‘ভেঁপুতে বেহাগ’ ‘অন্ধকারের আয়না’, ‘ইতিহাস কাঁদে’, ‘ভূমিকম্পের আগে’, ‘দুই বোন’, ‘ফিঙ্গার প্রিন্ট’, ‘দেওয়ান গাজীর কিস্সা’, ‘ভূমিকম্পের পরে’, ‘বাকি ইতিহাস’, ‘সেনাপতি’, ‘ক্যাপ্টেন হুররা’, ‘যদিও সন্ধ্যা’, ‘ত্রিরত্ন’, ‘দ্যাশের মানুষ’, ‘ক্ষত বিক্ষত’, ‘এখনো ক্রীতদাস’, ‘পাথর’, ‘সাজানো বাগান’, ‘চোখে আঙ্গুল দাদা’ উল্লেখযোগ্য।
১৯৭৩ খ্রি. ময়মনসিংহ আন্তজেলা নাট্যোৎসবে কাজী বোরহান পরিচালিত ‘ভূমিকম্পের পরে’ নাটকটি ১১টির মধ্যে ৯টি পুরস্কার অর্জন করে। ১৯৭৬ খ্রি. বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি আয়োজিত জাতীয় নাট্যোৎসবে কাজী বোরহান পরিচালিত ও অভিনীত ‘ক্যাপ্টেন হুররা’ নাটকটি ‘এ’ ক্যাটাগরি মর্যাদা লাভ করে।
এসময় নাট্য সমিতির মঞ্চে নারী চরিত্রে অভিনয় করার জন্য বেশ কিছু নারী এগিয়ে আসেন। তাদের মধ্যে রেনু সরকার, ময়না নন্দী, মালা সরকার, জয়ন্তী সরকার, শিখা ঘোষ, সন্ধ্যা দাস, সাবেত্রী রায়, আজিজা খানম মনি, ছায়া আকবর, সতী নন্দী উল্লেখযোগ্য।
নাট্য সমিতিতে যেন নতুন প্রাণের সঞ্চার হয়। ২০০০ খ্রি. পরবর্তী উল্লেখযোগ্য নাটকগুলো হলো ‘মানুষ’, ‘ডিম্ব কাব্য’, ‘রাজ কার্য’, ‘মেহেরজান আরেকবার’, ‘নেপেন দারোগার দায়ভার’ ‘কবর’, ‘আ-মরি বাংলা ভাষা’, ‘নতুন মানুষ’, ‘তৃতীয় পুরুষ’, ‘দর্পণ সাক্ষী’, ‘মধুরেণু’, ‘রাতের অতিথি’, ‘স্বাধীনতার সংগ্রাম’, ‘এখনও যুদ্ধ’, ‘লাল সূর্যের দেশে’, ‘ক্ষ্যাপা পাগলার প্যাচাল’, ‘হত্যারে’, ‘হত্যার শিল্পকলা’, ‘অরাজনৈতিক’, ‘দায়বদ্ধ’, ‘সুবচন নির্বাসনে’, ‘যামিনীর শেষ সংলাপ’, ‘উনিশশো একাত্তর’, ‘আতর আলীদের নীলাভ পাট’, ‘মেরাজ ফকিরের মা’, ‘শুনো হে লখিন্দর’, ‘সাদা কাগজ’, ‘কনক সরোজিনী’, ‘বীরবান্টা’, ‘হিং টিং ছট’ এবং রক্তকরবী অবলম্বনে ‘নন্দিনীর পালা’।
২০১৫ খ্রি. নাট্য সমিতির শতবর্ষপূর্তি উপলক্ষে একবিংশ নাট্যোৎসব ও প্রতিযোগিতা এবং ২০১৮ খ্রি. মাস ব্যাপী দ্বাবিংশ নাট্যোৎসব ও প্রতিযোগিতা সফলভাবে আয়োজিত ও সম্পন্ন হয়। এই উৎসবে ভারতের ৫টি ও বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা থেকে মোট ২৩টি নাটক মঞ্চস্থ হয়। উল্লেখ্য ভারতের বেশ কয়েকটি নাট্যদল অংশগ্রহণ করায় উৎসব দুটি আন্তর্জাতিক মর্যাদা লাভ করে। আজীবন কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ সে বছরই দেশের অন্যতম বিশিষ্ট নাট্যজন দিনাজপুর নাট্য সমিতির অধ্যক্ষ কাজী বোরহান বাংলাদেশ শিল্পকলা পদকে ভূষিত হন যা দিনাজপুর নাট্য সমিতির জন্য গৌরবের বিষয়।
২০১৮ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে ভারতের কলকাতায় অনীক আয়োজিত গঙ্গা-যমুনা নাট্যোৎসবে দিনাজপুর নাট্য সমিতি প্রথমবার নাটক মঞ্চয়ন করে, একই সময়ে রায়গঞ্জের সৌহার্দ নাট্যোৎসবে এবং চন্দন নগর রবীন্দ্র ভবনে মাহমুদুল ইসলাম সেলিম রচিত, নয়ন বার্টেল নির্দেশিত কনক সরোজিনী নাটকটি ব্যাপকভাবে দর্শক নন্দিত হয়। ভারতীয় বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় নাটকটির ভূয়সী প্রশংসা করা হয়। নাট্য সমিতির মর্যাদা দেশের বাহিরেও ছড়িয়ে পড়ে।
করোনাকালীন সারা দেশের সকল সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড বন্ধ হয়ে পড়ে। এ অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলে ঢাকার বাইরে নাট্যসমিতিই তার ‘স্বপ্নভঙ্গের রঙ্গমঞ্চ’ নাটকটি নিয়ে ফিরে আসে মঞ্চে। নাট্যসমিতি ‘হিং টিং ছট’ শিশুনাটক প্রযোজনার মধ্য দিয়ে শুরু করে শিশুনাট্যের নবযাত্রা। এরপর রবিঠাকুরের ‘রক্তকরবী’ অবলম্বনে সমকালীন বিশ্বের নতুনতর আর্থ-রাজনৈতিক ব্যাখ্যায় মঞ্চস্থ হয় সম্বিত সাহার রচনায় ও নির্দেশনায় ‘নন্দিনীর পালা’।
১৯১৩ থেকে ২০২২ খ্রি. পর্যন্ত পথচলার দীর্ঘ পরিক্রমায় নানান ঘাত-প্রতিঘাত, উত্থান-পতন, স্থবিরতা-গতিমানতা এসেছে; কিন্তু দিনাজপুর নাট্য সমিতি কখনোই তার নাট্যচর্চার গতিপথ থেকে বিচ্যুত হয়নি। একটি নাটকের শত মঞ্চায়ন যেমন কঠিন তার থেকে আরো অনেক বেশি কঠিন শতবর্ষজুড়ে একই আদর্শে লালিত হয়ে নাট্যচর্চার ধারাকে অব্যাহত রাখা। দিনাজপুর নাট্য সমিতি বাংলাদেশে নাট্যচর্চার ক্ষেত্রে সংস্কৃতির ইতিহাসে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবে ভূমিকা রেখেছে। এছাড়াও ভাষা আন্দালন, মহান মুক্তিযুদ্ধ ও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক আন্দোলনে সর্বদা দৃঢ় ভূমিকা পালন করেছে।
ভবিষ্যতের নাট্যচর্চাকে আরও বেগবান ও যুগপোযোগী করতে দিনাজপুর নাট্য সমিতি একটি আধুনিক নাট্য মঞ্চ নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। শিশুদের নিয়ে নাট্যচর্চার পদক্ষেপ হিসেবে নিয়মিতভাবে আয়োজন করতে যাচ্ছে শিশুনাট্যোৎসবের। আধুনিক থিয়েটারের নিয়মিত চর্চা ও অগ্রগতির লক্ষ্যে খুব শীঘ্রই নাট্যসমিতি স্বল্পমেয়াদী নাট্যপ্রশিক্ষণ কোর্স চালু করতে যাচ্ছে। বাংলাদেশের সকল জেলা শহরের নাট্যপাণ্ডুলিপি ও নাট্যনিবন্ধ সংকলন করে একটি নিয়মিত নাট্যপত্রিকা প্রকাশের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। শতবর্ষের নাট্যচর্চার স্বীকৃতি স্বরূপ নাট্যসমিতি ‘সৃজনশীল সাংস্কৃতিক সংগঠন’ হিসেবে শিল্পকলা পদক ২০২০ এ ভূষিত হয়েছে। এই স্বীকৃতি ও সম্মান শুধু নাট্যসমিতির নয় বরং আপামর দিনাজপুরের সংস্কৃতিমনস্ক জনগোষ্ঠীর তথা এদেশের সকল সাংস্কৃতিক কর্মীর।
নাট্যজগতের সুবিশাল আকাশে দিনাজপুর নাট্য সমিতি উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো তার দ্যুতি ছড়াচ্ছে। এই আলোকচ্ছটা অসীম আলোকবর্ষ পর্যন্ত এগিয়ে যাবে এই আমাদের দৃঢ় প্রত্যয়। জয় হোক নাটকের; জয় হোক নাট্য সমিতির।
শতবর্ষের ঐতিহ্যে দীপ্ত দিনাজপুর নাট্য সমিতি
শতবর্ষের ঐতিহ্যে দীপ্ত দিনাজপুর নাট্য সমিতি
প্রাচীনতম একটি সংগঠন দিনাজপুর নাট্য সমিতি ১৯১৩ সালের ২১শে জুন ‘চন্দ্রগুপ্ত’ নাটক মঞ্চায়নের মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে এবং একটি সৌখিন সংগঠন হওয়া সত্ত্বেও প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে দেশ বিভাগের পূর্ব পর্যন্ত তৎকালীন কলকাতার পেশাদার থিয়েটার অঙ্গনে অভিনীত বেশ কয়েকটি নাটকের সফল মঞ্চায়ন করে, যার প্রায় সব ক’টি দর্শক-নন্দিত হয়।
বিংশশতকের শুরুর দিক থেকে সামন্ত-সমাজের সাথে সাথে এ অঞ্চলের নাট্য-সংস্কৃতিতে জমিদার শ্রেণীর পৃষ্ঠপোষকতা ধীরে ধীরে লুপ্ত হতে থাকে। ফলে, পেশাদার থিয়েটার বিকাশের ক্ষেত্রে নানারকম অন্তরায় সৃষ্টি হয়। কিন্তু দিনাজপুর নাট্য সমিতি তখন সব ধরণের প্রতিকুলতাকে উপেক্ষা করে বহু পৌরানিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক নাটকের সফল মঞ্চায়ন করে এবং সাধারণ দর্শকের, বিশেষত মধ্যবিত্ত শ্রেনীর, পৃষ্ঠপোষকতা অর্জনের উপায় খুঁজে পেতে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৩৫ থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত নাট্য সমিতিতে নিয়মিতভাবে প্রতি শনিবার রাত দশটা থেকে রাত প্রায় তিনটা পর্যন্ত নাটক মঞ্চায়িত হত।
এ সময়কালে বাংলা সাহিত্যের অমর কথা শিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায় ও মন্মথ রায়, অভিনেতা ও আবৃত্তিকার শম্ভু মিত্র, চলচ্চিত্র নির্মাতা রাজেন তরফদার ও সুভাষ দত্ত, ভাস্কর্যশিল্পী নিতুন কুণ্ডু সহ উপমহাদেশের বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বের উপস্থিতি ও অংশগ্রহণ নাট্য সমিতিকে স্মৃতিধন্য করে রেখেছে।
কেবলমাত্র ধর্মের ভিত্তিতে ভারতবর্ষের বিভক্তি এবং রাষ্ট্রীয় প্ররোচনায় সৃষ্ট সাম্প্রদায়িক সহিংসতার কারণে ১৯৪৮ সালে সারা দেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ দলে দলে দেশত্যাগ করে। এরই অনিবার্য পরিনতিতে দিনাজপুরের বেশ কয়েকজন নেতৃস্থানীয় নাট্য সংগঠক পাড়ি জমান ভারতের পশ্চিমবঙ্গে। ফলে, দিনাজপুর নাট্য সমিতি তথা দিনাজপুরের নাট্যাঙ্গন কিছুকালের জন্য স্থবির হয়ে পড়ে। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালীর স্বাধীনতা-চিন্তার যে উন্মেষ ঘটে তার প্রভাব পড়ে বাংলার সংস্কৃতি-অঙ্গনে। নতুন করে কর্মচঞ্চল হয়ে ওঠে দিনাজপুরের নাট্যাঙ্গন। দেশ বিভাগের সময়ে এ অঞ্চলে থেকে যাওয়া বেশ কিছু হিন্দু পরিবারের পাশাপাশি অগ্রসর চিন্তার অনেক মুসলিম পরিবারের তরুণরা তখন হাল ধরে নাট্য সমিতির।
ধারণা করা হয়, প্রতিষ্ঠার পরপরই দর্শনীর বিনিময়ে নাটক প্রদর্শনের সারা শুরু করে নাট্য সমিতি। পরবর্তীতে ১৯৬৩ সালে পঞ্চাশ বছর পূর্তিতে যে উৎসব অনুষ্ঠিত হয় তাতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে প্রথমবারের মতো আয়োজন করা হয় আন্তঃজেলা নাট্য উৎসব ও অভিনয় প্রতিযোগিতা।
দিনাজপুর নাট্য সমিতির তথা দিনাজপুরের এই দুঃসাহসিক আয়োজন বাংলা নাট্যচর্চার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ মাইল ফলক হিসাবে বিবেচিত। পরপর বেশ কয়েক বছর আন্তঃজেলা নাট্য উৎসব ও অভিনয় প্রতিযোগিতা আয়োজনের ফলে উত্তর বঙ্গের অনেক জেলায়, কোথাও কোথাও মহকুমা ও থানা পর্যায়ে, নতুন নতুন নাট্য গোষ্ঠী ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের জন্ম হয় এবং বিভিন্ন এলাকার নাট্য গোষ্ঠীর মধ্যে সংস্কৃতি বিনিময়ের অবারিত সুযোগ সৃষ্টি হয়।
এইভাবে নিয়মিত বিশুদ্ধ নাট্য চর্চার পাশাপাশি মানুষের অধিকার আদায়ের স্বপক্ষে সব ধরনের কর্মকান্ড পরিচালনা করতে থাকে নাট্য সমিতি। এদেশের ভাষা-শিক্ষা-স্বাধিকার ও স্বাধীনতা আন্দোলনের বাঁকে বাঁকে মানুষকে উজ্জীবিত করার প্রয়োজনে সময়োপযোগী নাটক মঞ্চায়নের মধ্য দিয়ে উত্তরবঙ্গের তথা বাংলা নাটক ও সংস্কৃতি চর্চার অন্যতম কেন্দ্রে পরিণত হয় প্রতিষ্ঠানটি।
তাই, ১৯৭১ সালে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন এদেশের স্বাধীনতা- বিরোধী শক্তি পাকিস্তানী হানাদারদের সাথে নিয়ে গুড়িয়ে দেয় সংগঠনটির অবকাঠামো, আগুন দিয়ে পুড়ে ফেলে আসবাবপত্র দলিল সবকিছু। ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয় বাংলা নাটক ও সংস্কৃতির অন্যতম একটি নিদর্শন। কিন্তু এভাবে কি ধ্বংস করা যায় কোন জাতির আপন সংস্কৃতির ধারায় নির্মিত কোন সংগঠন?
মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা-দীপ্ত প্রজন্ম ৭১-পরবর্তীকালে নতুন করে রচনা করতে থাকে গৌরব গাঁথা। নিয়মিত নাটক মঞ্চায়নের পাশাপাশি উৎসব আয়োজন চলতে থাকে প্রতি দুই বছর অন্তর অন্তর। আমন্ত্রিত দল হিসাবে নাট্য সমিতি অংশগ্রহণ করতে থাকে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের নাট্য উৎসবে। ১৯৭৩ সালে ময়মনসিংহ আন্তঃজেলা নাট্য উৎসবে অংশগ্রহণ করলে ১১টির মধ্যে ০৯টি পুরস্কার পায় দিনাজপুর নাট্য সমিতি, সেখানে মঞ্চস্থ করে নাটক ‘ভূমিকম্পের পরে’। আবার ১৯৭৬ সালে ঢাকা শিল্পকলা একাডেমীতে ‘ক্যাপ্টেন হুররা‘ নাটক সফলভাবে মঞ্চস্থ হওয়ায় নাট্য সমিতিকে ‘এ’ ক্যাটাগরির স্বীকৃতি প্রদান করা হয়।
সামরিক শাসন ও নানান বিধিনিষেধ জারি থাকায় পুরো আশির দশক জুড়ে উৎসব আয়োজন বন্ধ থাকে নাট্য সমিতির। ১৯৯৪ সাল থেকে আবার তা শুরু হলেও অস্থির রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং সাম্প্রদায়িক সহিংসতার কারণে বারবার তা ব্যাহত হয়। ২০১০ সালে মাসব্যাপি সফলভাবে সম্পন্ন হয় দিনাজপুর নাট্য সমিতির বিংশতিতম নাট্য উৎসব ও প্রতিযোগিতা।
নাটক: মেরাজ ফকিরের মা, নাট্যকার: আবদুল্লাহ আল মামুন
নাটক: মেরাজ ফকিরের মা,
রচনা: আবদুল্লাহ আল মামুন (নাট্যকার)
নাটকের কাহিনি গড়ে উঠেছে ধর্মীয় অনুভূতিকে কেন্দ্র করে। এক মায়ের গর্ভে জন্ম নিয়ে একজন মানুষ বেড়ে উঠেছে একটি নামে। দীর্ঘ ৩৯ বছর পর আকস্মিকভাবে সে জানতে পারে তার গর্ভধারিণী মায়ের ধর্ম আর তার ধর্ম এক নয়।
ধর্ম পরিচয়ে যে ফারাক রচিত হয় তা কি মা-ছেলের সম্পর্ককে ফারাক করে দিতে পারে? ধর্মের ভিন্নতার কারণে ছেলে কি অস্বীকার করতে পারে তার মাকে?
এমনি সব প্রশ্নের উত্তর খোঁজা এবং মানবের স্বরূপ প্রকাশের চেষ্টা হয়েছে মেরাজ ফকিরের মা নাটকে।
মির্জা আনোয়ারুল ইসলাম তানুর প্রয়াণ দিবসে নাট্য সমিতি স্মরণ
মির্জা আনোয়ারুল ইসলাম তানুর প্রয়াণ দিবসে নাট্য সমিতি স্মরণ –
ভাষাসৈনিক ও সিপিবি নেতা মির্জা আনোয়ারুল ইসলাম
নাট্যমঞ্চ ইতিহাস
দিনাজপুর নাট্য সমিতি মঞ্চে নাট্যাভিনয় প্রদর্শনকারী সংগঠন। মঞ্চ-নাটকে সমাজ জীবনের বিভিন্ন প্রতিচ্ছবি সরাসরি অভিনয়ের মাধ্যমে দর্শকদের সামনে তুলে ধরা হয়। নাট্যচর্চার ক্ষেত্র সৃষ্টির লক্ষ্যে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন নাট্য সংগঠন গড়ে ওঠেছে।
পরে জমিদার ও নাট্যামোদী ব্যক্তিগণের উদ্যোগে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয় একের পর এক নাট্য সংগঠন। ভারত বিভাগ পূর্বে ঢাকায় নাট্যচর্চা অব্যাহত রাখার জন্য বেশ কয়েকটি নাট্যগোষ্ঠী প্রতিষ্ঠিত হয়, যেমন: ইলিশিয়াম থিয়েটার (১৮৮৮), ক্রাউন থিয়েটার (১৮৯০-৯২) ইত্যাদি। ঢাকার বাইরেও কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গোষ্ঠী নাট্যচর্চা করত সেই সময়,
যেমন: খুলনা থিয়েটার (১৯০০), করোনেশন ড্রামাটিক ক্লাব (টাঙ্গাইল, ১৯১১), দিনাজপুর নাট্য সমিতি (১৯১৩) ইত্যাদি। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর যেসব নাট্যগোষ্ঠীর জন্ম হয় সেগুলি: হাবিব প্রডাকসন্স (ঢাকা, ১৯৫২), ড্রামা সার্কেল (ঢাকা, ১৯৫৫), খেয়ালী গ্রুপ থিয়েটার (বরিশাল, ১৯৬৯) ইত্যাদি।
১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ঢাকাসহ দেশের সর্বত্র বহুসংখ্যক নাট্য সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয় ফলে নাট্যচর্চার গতি আরো বেগবান হয়। নাট্যচর্চার ক্ষেত্রে যেসব নাট্যগোষ্ঠী বিশেষ পরিচিতি লাভ করেছে তাদের সংক্ষিপ্ত একটি তালিকা নিম্নরূপ:
নাট্যগোষ্ঠীর নাম | স্থান | প্রতিষ্ঠা সাল |
বাগবাজার অ্যামেচার থিয়েটার | কলকাতা | ১৮৬৭ |
গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটার | কলকাতা | ১৮৭৩ |
ইলিশিয়াম থিয়েটার | ঢাকা | ১৮৮৮ |
ক্রাউন থিয়েটার | ঢাকা | ১৮৯০-১৮৯২ |
ডায়মন্ড জুবিলি থিয়েটার | ঢাকা | ১৮৯৭ |
খুলনা থিয়েটার | খুলনা | ১৯০০ |
করোনেশন ড্রামাটিক ক্লাব | টাঙ্গাইল | ১৯১১ |
দিনাজপুর নাট্য সমিতি | দিনাজপুর | ১৯১৩ |
আমাদের থিয়েটার | দিনাজপুর | ১৯৯২ |
হাবিব প্রোডাকশন্স | ঢাকা | ১৯৫২ |
ড্রামা সার্কেল | ঢাকা | ১৯৫৬ |
নবরূপী | দিনাজপুর | ১৯৬৩ |
শিখা সংসদ | রংপুর | ১৯৬৬ |
নাগরিক নাট্য সম্প্রদায় | ঢাকা | ১৯৬৮ |
খেয়ালী গ্রুপ থিয়েটার | বরিশাল | ১৯৬৯ |
আরণ্যক নাট্যদল | ঢাকা | ১৯৭১ |
থিয়েটার (বেইলি রোড) | ঢাকা | ১৯৭২ |
নাট্যচক্র | ঢাকা | ১৯৭২ |
বগুড়া নাট্যগোষ্ঠী | বগুড়া | ১৯৭২ |
বহুবচন | ঢাকা | ১৯৭২ |
ঢাকা থিয়েটার | ঢাকা | ১৯৭৩ |
অরিন্দম নাট্য সম্প্রদায় | চট্টগ্রাম | ১৯৭৪ |
তির্যক নাট্যদল | চট্টগ্রাম | ১৯৭৪ |
গণায়ন নাট্য সম্প্রদায় | চট্টগ্রাম | ১৯৭৫ |
যাত্রিক নাট্যগোষ্ঠী | কুমিল্লা | ১৯৭৫ |
রঙ্গরূপ নাট্য একাডেমী | ঢাকা | ১৯৭৫ |
নারায়ণগঞ্জ থিয়েটার | নারায়ণগঞ্জ | ১৯৭৬ |
নান্দনিক নাট্য সম্প্রদায় | ঢাকা | ১৯৭৭ |
বরিশাল নাটক | বরিশাল | ১৯৭৭ |
জনান্তিক নাট্য সম্প্রদায় | কুমিল্লা | ১৯৭৮ |
ঢাকা লিটল থিয়েটার | ঢাকা | ১৯৭৮ |
তরুণ সম্প্রদায় | সিরাজগঞ্জ | ১৯৭৮ |
পদাতিক নাট্য সংসদ | ঢাকা | ১৯৭৮ |
শব্দাবলী গ্রুপ থিয়েটার | বরিশাল | ১৯৭৮ |
অনন্যা ’৭৯ | কুষ্টিয়া | ১৯৭৯ |
অনুশীলন নাট্যদল | রাজশাহী | ১৯৭৯ |
বোধন থিয়েটার | কুষ্টিয়া | ১৯৭৯ |
ঢাকা পদাতিক | ঢাকা | ১৯৮০ |
বগুড়া থিয়েটার | বগুড়া | ১৯৮০ |
লোকনাট্য দল | ঢাকা | ১৯৮১ |
সন্ধানী নাট্যচক্র | সিলেট | ১৯৮১ |
অনির্বাণ সাংস্কৃতিক সংগঠন | দর্শনা | ১৯৮৩ |
থিয়েটার (আরামবাগ) | ঢাকা | ১৯৮৩ |
সুরমা থিয়েটার | সিলেট | ১৯৮৩ |
নাট্যকেন্দ্র | ঢাকা | ১৯৯০ |
তির্যক নাট্যগোষ্ঠী | চট্টগ্রাম | ১৯৯০ |
ফরিদপুর থিয়েটার | ফরিদপুর | ১৯৯০ |
থিয়েটার (তোপখানা) | ঢাকা | ? |
থিয়েটার ’৭৩ | চট্টগ্রাম | ১৯৭৩ |
নাট্যমঞ্চ
নাট্যমঞ্চ প্রথম বাংলা নাট্যমঞ্চ নির্মাণ করেন রুশ মনীষী লেবেদেফ। ১৭৯৫ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার ডোমতলায় (বর্তমান এজরা স্ট্রিট) তিনি ‘বেঙ্গলী থিয়েটার’ স্থাপন করে ২৭ নভেম্বর কাল্পনিক সংবদল নামক একটি বাংলা অনুবাদ-নাটক মঞ্চস্থ করেন। এর আগে কলকাতায় ইংরেজদের প্রতিষ্ঠিত দুটি নাট্যমঞ্চ ছিল, যেখানে কেবল ইংরেজি নাটকই অভিনীত হতো।
লেবেদেফের সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে উনিশ শতকে বাঙালিরা কলকাতায় বেশ কয়েকটি নাট্যমঞ্চ নির্মাণ করেন, যেমন: হিন্দু থিয়েটার (১৮৩১), ওরিয়েন্টাল থিয়েটার (১৮৫৩), জোড়াসাঁকো নাট্যশালা (১৮৫৪), বিদ্যোৎসাহিনী মঞ্চ (১৮৫৭) ইত্যাদি। উনিশ শতকের শেষভাগে ঢাকায়ও কয়েকটি নাট্যমঞ্চ নির্মিত হয়, যেমন: পূর্ববঙ্গ রঙ্গভূমি (১৮৬৫), ক্রাউন থিয়েটার মঞ্চ (১৮৯০-৯২ এর মধ্যে), ডায়মন্ড জুবিলি থিয়েটার (১৮৯৭) ইত্যাদি। এ সময় মুন্সিগঞ্জ শহরে ‘জগদ্ধাত্রী নাট্যমঞ্চ’ নামে একটি মঞ্চ নির্মিত হয়, যা এখনও বর্তমান। বিশ শতকের প্রথম দুই দশকে ঢাকার বাইরে বেশ কয়েকটি মঞ্চ নির্মিত হয়, যেমন: খুলনা থিয়েটার (১৯০৫), করোনেশন ড্রামাটিক ক্লাব ( টাঙ্গাইল, ১৯১১) ইত্যাদি। এ সময় টাঙ্গাইলের সন্তোষ, এলেংগা, শিবপুর, আলোয়া ও করটিয়ার জমিদাররা বেশ কয়েকটি মঞ্চ প্রতিষ্ঠা করেন।
১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর ঢাকায় নির্মিত হয় মাহবুব আলী ইনস্টিটিউট (১৯৫০)। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর দীর্ঘকাল যাবৎ ঢাকায় স্বতন্ত্র কোন নাট্যমঞ্চ নির্মিত না হলেও বেশ কয়েকটি সাধারণ মঞ্চ বিশেষভাবে নাট্যাভিনয়ের জন্য ব্যবহূত হতে থাকে, যেমন: মহিলা সমিতি মিলনায়তন, গাইড হাউস মিলনায়তন ইত্যাদি। সম্প্রতি ঢাকার গুলিস্তানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ৬০০ আসনবিশিষ্ট ‘ঢাকা মহানগর নাট্যমঞ্চ’। এখানে প্রধানত নাট্যাভিনয় হয়। এগুলি ছাড়া ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বেশ কয়েকটি সাধারণ মঞ্চে নাটকের অভিনয় হয়, যেমন: ব্রিটিশ কাউন্সিল মিলনায়তন, গণগ্রন্থাগার মিলনায়তন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র-শিক্ষক মিলনায়তন, কচিকাঁচা মিলনায়তন, ওয়াপদা মিলনায়তন, অশ্বিনীকুমার টাউন হল (বরিশাল, ১৯৩০), জে.এম.সেন হল (চট্টগ্রাম), মুসলিম হল (চট্টগ্রাম) ইত্যাদি। উভয় বঙ্গের কয়েকটি প্রধান নাট্যমঞ্চের সংক্ষিপ্ত বিবরণ নিম্নে দেওয়া হলো:
এমারেল্ড থিয়েটার ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয়। কলুটোলা নিবাসী গোপাললাল শীল এর প্রতিষ্ঠাতা। তিনি বহু অর্থ ব্যয় করে থিয়েটারের জন্য জাঁকজমকপূর্ণ দৃশ্যপট ও পোশাক-পরিচ্ছদ তৈরি করান এবং গ্যাসের আলোর পরিবর্তে ডায়নামোর সাহায্যে বৈদ্যুতিক আলোর ব্যবস্থা করেন। প্রতিষ্ঠা বছরেরই ৮ অক্টোবর থিয়েটারের উদ্বোধন দিবসে কেদারলাল চৌধুরীর একখানি পৌরাণিক নাটক মঞ্চস্থ হয়; কিন্তু দক্ষ পরিচালনার অভাবে থিয়েটারের দর্শকসংখ্যা ক্রমশ হ্রাস পেতে থাকে। এমতাবস্থায় গোপাল শীলের আমন্ত্রণে গিরিশচন্দ্র ঘোষ এর দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং কয়েকখানি পুরাতন ও নতুন নাটক মঞ্চস্থ করেন। সেগুলির মধ্যে পূর্ণচন্দ্র ও বিষাদ খুব জনপ্রিয় হয়েছিল।
কিছুদিন পরে প্রখ্যাত মঞ্চাধ্যক্ষ ধর্মদাস সুর এর মঞ্চসজ্জায় নিযুক্ত হন। কিন্তু খেয়ালি মানুষ গোপাল শীল দুবছরের মাথায় থিয়েটার বিক্রি করে দেন। তার পরেও বিভিন্ন মালিকানায় ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি পর্যন্ত এর কার্যক্রম অব্যাহত ছিল। কেদারলাল রায়, গিরিশচন্দ্র ঘোষ, দীনবন্ধু মিত্র, অতুলকৃষ্ণ মিত্র, ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদ এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রায় ৪০খানা নাটক এমারেল্ড থিয়েটারে অভিনীত হয়। এর প্রধান শিল্পীদের মধ্যে ছিলেন অর্ধেন্দুশেখর মুস্তফি, মহেন্দ্র বসু, রাধামাধব কর, মতিলাল সুর, বনবিহারিণী, ক্ষেত্রমণি, সুকুমারী, কুসুম, গুল্ফন হরি প্রমুখ।
ওরিয়েন্টাল থিয়েটার ১৮৫৩ সালে কলকাতার ২৬৮ নং গরানহাটা, চিৎপুরে গৌরমোহন আড্ডির ওরিয়েন্টাল সেমিনারি স্কুল বাড়ির মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রধানত স্কুলের প্রাক্তন ও বর্তমান ছাত্ররাই অভিনয়ে অংশগ্রহণ করতেন। শেক্সপীয়রের ওথেলো নাটকের অভিনয়ের জন্য মি. ক্লিঞ্জার ও মিসেস এলিস ছাত্রদের শিক্ষা দেন। প্রতিষ্ঠা বছরের ২৬ সেপ্টেম্বর নাটকটির প্রথম অভিনয় হয় এবং এর দ্বিতীয় অভিনয় হয় ৫ অক্টোবর।
১৮৫৪ সালের ২ ও ১৭ মার্চ ওরিয়েন্টাল থিয়েটারে মঞ্চস্থ হয় মার্চেন্ট অফ ভেনিস। মিসেস গ্রেইর্গ নামে জনৈকা মহিলা ‘পোর্সিয়া’র ভূমিকায় অভিনয় করেন। পরের বছর ১৫ ফেব্রুয়ারি শেক্সপীয়রের হেনরি ফোর্থ ও হেনরি পার্কার মেরিডিথের এ্যামেচার নাটকদুটি অভিনীত হয়। ১৮৫৭ সালের মে মাসে শেক্সপীয়রের আর একখানি নাটক অভিনয়ের বিবরণ প্রকাশিত হয় সংবাদ প্রভাকরে।
ওরিয়েন্টাল থিয়েটারের ব্যয় নির্বাহ হতো টিকেট বিক্রয়ের অর্থ দিয়ে, যেহেতু এটি কোন বিত্তবানের প্রাসাদের থিয়েটার ছিল না। এর নাট্যাভিনয়ের বিজ্ঞাপন এবং বিবরণসমূহ সংবাদ প্রভাকর, বেঙ্গল হরকরা, হিন্দু প্যাট্রিয়ট, দি মর্নিং ক্রনিকল, দি সিটিজেন ইত্যাদি পত্রিকায় প্রকাশিত হতো। [গণেশ মুখোপাধ্যায়]
ক্রাউন থিয়েটার মঞ্চ ১৮৯০ থেকে ১৮৯২ সালের মধ্যে কোনও এক সময় পুরান ঢাকার নবাব বাড়ির সন্নিকটে প্রতিষ্ঠিত হয়। এখানে প্রথমে ছিল ‘পূর্ববঙ্গ রঙ্গভূমি’ নাট্যগোষ্ঠীর মঞ্চ; কিন্তু এই গোষ্ঠীর কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেলে ক্রাউন থিয়েটার সেটি ভেঙ্গে নতুন করে মঞ্চ নির্মাণ করে। স্থানীয় বাসিন্দাদের আপত্তির কারণে মঞ্চটি এক সময় ইসলামপুরে স্থানান্তরিত হয়। ১৮৯৭ সালে ‘ডায়মন্ড জুবিলি থিয়েটার’ প্রতিষ্ঠিত হলে ক্রাউন থিয়েটারের কতিপয় অভিনেতা-অভিনেত্রী সেখানে যোগ দেন এবং এর ফলে ক্রাউনের কর্মকান্ড ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিছুকাল পরে ক্রাউন থিয়েটার চলচ্চিত্র প্রদর্শন শুরু করলে নাট্যমঞ্চ হিসেবে এর অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়ে যায়।
গাইড হাউস মিলনায়তন ঢাকার নিউ বেইলী রোডে বাংলাদেশ গার্লস গাইড অ্যাসোসিয়েশনের কার্যালয় প্রাঙ্গণে অবস্থিত। আশির দশক থেকে এই মঞ্চটি নিয়মিত নাট্য প্রদর্শনীর অন্যতম কেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। নাট্য প্রদর্শনীর সংখ্যাবৃদ্ধি, নতুন নতুন নাট্যদলের উদ্ভব, নাটকের দর্শক সৃষ্টি ইত্যাদি উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে গাইড হাউস মিলনায়তনের কর্মকান্ড পরিচালিত হয়। দ্বিতীয় ধাপে ঢাকা শহরে এখানেই প্রথম দর্শনীর বিনিময়ে নাট্য প্রদর্শনী শুরু হয়।
গাইড হাউস মিলনায়তনে বিভিন্ন নাট্যদল কর্তৃক মঞ্চস্থ কয়েকটি প্রধান নাটক হলো: বহুবচনের প্রজাপতির লীলালাস্য (১৯৭২), ইডিপাস (১৯৮২); থিয়েটারের পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় (১৯৭৬), ঘরে-বাইরে (১৯৮৫), কোকিলারা (১৯৮৯), আন্তিগোনে (১৯৯২); ঢাকা থিয়েটারের শকুন্তলা (১৯৭৮); নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের দেওয়ান গাজীর কিস্সা, বিসর্জন (১৯৮৫); সুবচন নাট্য সংসদের জীবন ঘষে আগুন (১৯৮৬); লোক নাট্যদলের পদ্মা নদীর মাঝি (১৯৯১), মহাপ্রয়াণ (১৯৯৪), একাত্তরের দিনগুলো (১৯৯৫); সময় সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর আসমান তারা শাড়ী (১৯৯১), বাজিমাৎ (১৯৯৪); কুশিলব নাট্য সম্প্রদায়ের নো ভেকেনসি (১৯৯১); নাট্যকেন্দ্রের বিচ্ছু (১৯৯১), লালসালু (১৯৯১), তুঘলোক (১৯৯২); সড়কের হ্যালুসিনেশন (১৯৯২); ঢাকা লিটল থিয়েটারের মার্চেন্ট অব ভেনিস (১৯৯৩); থিয়েটার আর্টের কোর্ট মার্শাল (১৯৯৩), কালান্তর (১৯৯৪), গোলাপজান (১৯৯৫); কণ্ঠশীলনের পুতুল খেলা (১৯৯৩), ভৃত্য রাজকতন্ত্র (১৯৯৫); ঢাকা সুবচন নাট্যদলের বিবিসাব (১৯৯৪); ঢাকা পদাতিকের ফেরা (১৯৯৪); জাহাঙ্গীরনগর থিয়েটারের পাবলিক (১৯৯৫) ইত্যাদি।
বাংলাদেশে দলীয় মূকাভিনয়ের পথিকৃৎ ঢাকা প্যান্টোমাইম (১৯৮৯) গাইড হাউস মঞ্চে দর্শনীর বিনিময়ে ১৯৯১-৯৩ সালের মধ্যে মঞ্চস্থ করে মানব ও প্রকৃতি, সভ্যতার ক্রমবিকাশ, ভাষা আন্দোলন, নদী পাড়ের জীবন, মাদকাশক্তি এবং স্বাধীনতা শীর্ষক মূকাভিনয়। নাটক ও মূকাভিনয় ছাড়াও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন এ মঞ্চে দর্শনীর বিনিময়ে নৃত্যানুষ্ঠানের আয়োজন করে।
গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটার ১৮৭৩ সালে ভুবনমোহন নিয়োগী কর্তৃক কলকাতার বিডন স্ট্রিটে (বর্তমান মিনার্ভা থিয়েটারের স্থলে) প্রতিষ্ঠিত হয়। কিছুদিন পরে কৃষ্ণধন বন্দ্যোপাধ্যায় মঞ্চটি লিজ নিয়ে ‘ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল থিয়েটার’ নামে পরিচালনা করেন; কিন্তু মাত্র চার মাসের মধ্যেই কৃষ্ণধন ঋণগ্রস্থ হয়ে পড়েন এবং ভূবনমোহন পুনরায় থিয়েটারটি নিজের হাতে নিয়ে পূর্বনামেই চালাতে থাকেন। ১৮৭৫ সালের ডিসেম্বর মাসে অমৃতলাল বসুর হীরকচূর্ণ ও উপেন্দ্রনাথ দাসের সুরেন্দ্র বিনোদিনী নাটক এখানে অভিনীত হয়। হীরকচূর্ণ নাটকে বাংলার রঙ্গমঞ্চে প্রথম রেলগাড়ি দেখানো হয়। পরবর্তীকালে এ মঞ্চে অভিনীত উল্লেখযোগ্য নাটকগুলি হলো: প্রকৃত বন্ধু, সরোজিনী, বিদ্যাসুন্দর, গজদানন্দ ও যুবরাজ, কর্ণাটকুমার ইত্যাদি।
গজদানন্দ ও যুবরাজ একটি কৌতুক নাটক; মহারাণী ভিক্টোরিয়ার পুত্র প্রিন্স অব ওয়েলস (সপ্তম এডওয়ার্ড) ১৮৭৫ সালের ১৩ ডিসেম্বর কলকাতায় এলে তাঁর আগমনকে কেন্দ্র করে নাটকটি রচিত হয়। এতে সরকারি মহলে অসন্তোষ দেখা দেয় এবং পুলিশ এর প্রদর্শনী বন্ধ করে দেয়। রচয়িতা উপেন্দ্রনাথ পুলিশকে বিদ্রূপ করে The Police of Pig and Sheep নামে আরও একটি কৌতুক নাটক রচনা করেন এবং ১৮৭৬ সালের ১ মার্চ নাটকটি এখানে মঞ্চস্থ হয়। এর পরিণতি হিসেবে নাট্যাভিনয়কে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সরকার ঐ বছরই অভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইন প্রণয়ন করে। এভাবে নাট্যচর্চার ক্ষেত্রে এক কালো অধ্যায়ের সৃষ্টি হয়। অভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইন, মামলা-মোকদ্দমা ইত্যাদি কারণে ভুবনমোহন সর্বস্বান্ত হয়ে থিয়েটারের সংস্রব ত্যাগ করেন এবং অন্যরাও থিয়েটার ছেড়ে চলে যান। ১৮৮০ সালে প্রতাপচাঁদ জহুরী নামে এক মাড়োয়ারি ব্যবসায়ী এটি ক্রয় করে গিরিশ ঘোষকে পরিচালনার দায়িত্ব দেন। [জিল্লুর রহমান জন]
জোড়াসাঁকো নাট্যশালা১ প্যারীমোহন বসু কর্তৃক ১৮৫৪ সালে তাঁর কলকাতাস্থ জোড়াসাঁকো বারাণসী ঘোষ স্ট্রিটের নিজস্ব বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত হয়। ঐ বছরই ৩ মে এই মঞ্চে শেক্সপীয়রের জুলিয়াস সিজার নাটকটি অভিনীত হয়। মহেন্দ্রনাথ বসু, কৃষ্ণধন দত্ত, যদুনাথ চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ অভিনয়ে অংশগ্রহণ করেন। সংবাদ প্রভাকর (৫ মে ১৮৫৪) পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা যায় যে, প্রায় চারশত ভারতীয় ও ইংরেজ দর্শক হিসেবে উপস্থিত ছিল। হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকা (১১ মে ১৮৫৪) নাট্যশালার নিকট বাঙালি দর্শকদের জন্য বাংলা ভাষায় নাটক অভিনয়ের প্রস্তাব দেয়।
জোড়াসাঁকো নাট্যশালা২ ১৮৬৫ সালে কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে প্রতিষ্ঠিত হয়। সেকালের বিখ্যাত গোপাল উড়িয়ার যাত্রাগান জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরকে মঞ্চাভিনয়ে উদ্বুদ্ধ করে এবং তিনি গুণেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও সারদাপ্রসাদ গাঙ্গুলীর সহায়তায় এ নাট্যশালা প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে মধুসূদনের কৃষ্ণকুমারী, একেই কি বলে সভ্যতা এবং গিরীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাবুবিলাস নাটক অভিনীত হয়। এরপর উদ্যোক্তাগণ সমকালীন সমাজের সমস্যা নিয়ে রচিত নাটক আহবান করে পুরস্কারসহ পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেন। বিচারকদের বিচারে রামনারায়ণ তর্করত্নের নবনাটক শ্রেষ্ঠরূপে নির্বাচিত হয় এবং নাট্যকারকে একটি রূপার থালায় ২০০ রৌপ্যমুদ্রা পুরস্কার প্রদান করা হয়। ১৮৬৭ সালের ৫ জানুয়ারি নাটকটি অভিনীত হয়। অক্ষয় মজুমদার, সারদা গাঙ্গুলী, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখ এতে অভিনয় করেন। ৯ জানুয়ারি ন্যাশনাল ও ২৮ জানুয়ারি সোমপ্রকাশ পত্রিকায় উক্ত প্রযোজনার উচ্চ প্রশংসা করা হয়। ২৩ ফেব্রুয়ারি ছিল জোড়াসাঁকো নাট্যশালার শেষ অভিনয়। [গণেশ মুখোপাধ্যায়]
ডায়মন্ড জুবিলি থিয়েটার জমিদার কিশোরীলাল রায়চৌধুরী কর্তৃক ১৮৯৭ সালে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয়। কিশোরীলাল প্রথমে ক্রাউন থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন; কিন্তু এক সময় এর শিল্পী ও কর্মকর্তাদের মধ্যে সমঝোতার অভাব দেখা দিলে তিনি ক্রাউনেরই কতিপয় শিল্পী নিয়ে ‘ডায়মন্ড জুবিলি থিয়েটার’ নামে একটি নাট্যগোষ্ঠী ও রঙ্গমঞ্চ প্রতিষ্ঠা করেন। পুরনো ঢাকার ইসলামপুরে বর্তমান লায়ন সিনেমা হলের জায়গায় এ মঞ্চটি নির্মিত হয়েছিল।
ডায়মন্ড কলকাতা থেকে অভিনেত্রী এনে, প্রয়োজনে স্থানীয় বাইজিদের দিয়ে অভিনয় করাত। এ মঞ্চে অভিনীত উল্লেখযোগ্য নাটকগুলি হলো: দুর্গেশনন্দিনী, দেবীচৌধুরানী, বিজয় বসন্ত, আলীবাবা, নবীন তপস্বিনী, বিল্বমঙ্গল, নন্দদুলাল, তরুবালা ইত্যাদি। এর টিকেটের হার ছিল দুই টাকা, এক টাকা, আট আনা ও চার আনা। ঢাকায় পেশাদার থিয়েটার প্রচলনের পেছনে ডায়মন্ড জুবিলি থিয়েটারের উল্লেখযোগ্য অবদান ছিল। [জিল্লুর রহমান জন]
ন্যাশনাল থিয়েটার ১৮৭২ সালে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয়। বাগবাজার অ্যামেচার থিয়েটারের সভ্যগণ সর্বশ্রেণীর দর্শকদের সুবিধার্থে একটি সাধারণ রঙ্গালয় প্রবর্তনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন এবং সে অনুযায়ী এটি নির্মিত হয়। এ কারণে মঞ্চটি প্রথম বাংলা সাধারণ রঙ্গমঞ্চ হিসেবে খ্যাত।
রঙ্গালয়ের টিকেট বিক্রয়ের অর্থে শুধু নিয়মিত নাট্য প্রযোজনার ব্যয়টুকু নির্বাহ করাই ছিল ন্যাশনালের কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্য। এ উদ্দেশ্যে ৩৩ নং চিৎপুর রোডে মধুসূদন সান্যালের মন্দির ভবনে একটি অস্থায়ী মঞ্চ নির্মাণ করা হয় এবং মঞ্চের নাম দেওয়া হয় ‘ন্যাশনাল থিয়েটার’। কিন্তু এরূপ একটি অস্থায়ী ও যৎকিঞ্চিৎ সজ্জিত মঞ্চের ‘ন্যাশনাল’ নাম নিয়ে দলপতি গিরিশচন্দ্রের সঙ্গে সাধারণ সভ্যদের মতবিরোধ দেখা দেয় এবং তিনি দলত্যাগ করেন। এমতাবস্থায় কার্যনির্বাহকের দায়িত্ব পালন করেন অর্ধেন্দুশেখর মুস্তফি। প্রতিষ্ঠা বছরেরই ৭ ডিসেম্বর দীনবন্ধু মিত্রের নীলদর্পণ নাটকের অভিনয়ের মাধ্যমে ন্যাশনাল থিয়েটারের দ্বারোদ্ঘাটন হয়। প্রথম দিকে প্রতি শনিবার এখানে অভিনয় হতো; পরের দিকে সপ্তাহে দুদিনও হয়েছে।
দীনবন্ধু মিত্র ছাড়াও শিশিরকুমার ঘোষ, কিরণচন্দ্র ব্যানার্জী, মাইকেল মধুসূদন দত্ত এবং রামনারায়ণ তর্করত্নেরও কয়েকটি নাটক ন্যাশনালে অভিনীত হয়েছে। মাঝে মাঝে অর্ধেন্দুশেখর মুস্তফি হাস্যরসাত্মক প্যান্টোমাইম পরিবেশন করতেন। উল্লেখযোগ্য অভিনেতাদের মধ্যে ছিলেন অর্ধেন্দু মুস্তফি, নগেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী, মতিলাল সুর, মহেন্দ্রনাথ বসু, অমৃতলাল বসু প্রমুখ। ১৮৭৩ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি হিন্দুমেলা নাটকে অভিনয়ের জন্য গিরিশচন্দ্র পুনরায় এতে যোগ দেন।
ন্যাশনাল থিয়েটারে শেষ অভিনয় হয় ১৮৭৩ সালের ৮ মার্চ। এর অল্পদিন পরেই ন্যাশনাল দুটি দলে ভাগ হয়ে যায় এবং নতুন দলের নাম হয় ‘হিন্দু ন্যাশনাল থিয়েটার’। সমকালীন সুলভ সমাচার, অমৃতবাজার পত্রিকা, ইন্ডিয়ান মিরর, ইংলিশম্যান ইত্যাদি পত্রিকায় ন্যাশনাল থিয়েটারের অভিনয় সম্পর্কে উচ্চ প্রশংসা করা হয়েছে। [গণেশ মুখোপাধ্যায়]
পূর্ববঙ্গ রঙ্গভূমি ১৮৬৫ সালে (মতান্তরে ১৮৭০-৭২ সালের মধ্যে) পুরান ঢাকায় বর্তমান জগন্নাথ কলেজের স্থানে জমিদার মোহিনীমোহন দাসের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয়। একে কেন্দ্র করে একটি নাট্যসমাজও গড়ে উঠেছিল। ১৮৭২ সালে রামাভিষেক নাটক মঞ্চায়নের মাধ্যমে এই রঙ্গমঞ্চই ঢাকায় প্রথম দর্শনীর বিনিময়ে নাট্যাভিনয় শুরু করে। টিকেটের হার ছিল চার, দুই ও এক টাকা, যা সময়ের বিবেচনায় ছিল অনেক বেশি। পৌরাণিক কাহিনী অবলম্বনে রচিত রামাভিষেক নাটকটি অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছিল।
‘প্রাইড অব বেঙ্গল থিয়েটার’ (১৮৬১) নামে একটি নাট্যগোষ্ঠী পূর্ববঙ্গ রঙ্গভূমি ভাড়া নিয়ে অভিনয় করত। তবে এ মঞ্চে শুধু নাটকই প্রদর্শিত হতো না, ঢাকার অধিকাংশ সভাও এখানেই অনুষ্ঠিত হতো। এদিক থেকে এটি তখন টাউন হলের প্রয়োজন মিটিয়েছে। ১৮৭৩ সালে মোহিনীমোহন দাসের পৃষ্ঠপোষকতায় কলকাতার হিন্দু ন্যাশনাল থিয়েটার ঢাকায় এসে পূর্ববঙ্গ রঙ্গভূমিতে নীলদর্পণ, নবীন তপস্বিনী, সধবার একাদশী, যেমন কর্ম তেমন ফল, বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ, ভারত মাতা ইত্যাদি নাটক মঞ্চস্থ করে। ১৮৭৬ সালে নবাব আবদুল গনির আমন্ত্রণে মুম্বাই থেকে একটি দল ঢাকায় এসে হিন্দি নাটক ইন্দ্রসভা মঞ্চস্থ করে। গন্নুবাঈ, আন্নুবাঈ ও নবায়ন এই তিনবোন ইন্দ্রসভায় অভিনয় করেন। ঢাকায় মহিলাদের দ্বারা অভিনয় এই প্রথম। তাঁরা যাদুনগর নামে অপর একটি নাটকও মঞ্চস্থ করেন। ১৮৮৪ সালে এখানে অভিনীত হয় উত্তররামচরিত। [জিল্লুর রহমান জন]
বঙ্গ নাট্যালয়১ ১৮৫৯ সালে জমিদার যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর ও শৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুর ভ্রাতৃদ্বয়ের প্রচেষ্টায় তাঁদের কলকাতাস্থ পাথুরিয়া ঘাটা প্রাসাদে প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠা বছর জুলাই মাসে কালিদাসের সংস্কৃত নাটক মালবিকাগ্নিমিত্রম্-এর অভিনয়ের মাধ্যমে এর যাত্রা শুরু হয়। পরের বছর ৭ জুলাই অভিনীত হয় রামনারায়ণ তর্করত্নকৃত উক্ত নাটকের বঙ্গানুবাদ। এরপর পাঁচ বছর এই নাট্যশালার কার্যক্রম বন্ধ থাকে। ১৮৬৬ সালের ৬ জানুয়ারি যতীন্দ্রমোহন নতুন দল গঠন করে ভারতচন্দ্রের বিদ্যাসুন্দর কাব্যের নাট্যরূপ মঞ্চস্থ করেন। এরপরেই অভিনীত হয় বুঝলে কিনা ব্যঙ্গ্যনাট্য। পরবর্তীকালে অভিনীত নাটকগুলি সবই রামনারায়ণকৃত: যেমন কর্ম তেমন ফল, চক্ষুদান, মালতীমাধব, উভয়সঙ্কট ও রুক্মিণীহরণ।
বঙ্গ নাট্যালয়ে উল্লেখযোগ্য নাট্য ব্যক্তিত্বগণের মধ্যে ছিলেন যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর, শৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুর, মদনমোহন বর্মণ, মহেন্দ্র মুখার্জী, রাধাপ্রসাদ বসাক, কৃষ্ণধন ব্যানার্জী প্রমুখ। ১৮৭২ সালে এর কর্মকান্ড বন্ধ হয়ে যায়।
বঙ্গ নাট্যালয়২ বলদেব ধর ও চুনিলাল ধরের যৌথ প্রচেষ্টায় ১৮৬৮ সালে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয়। এ বছরেরই মার্চ মাসে মনোমোহন বসুর রামাভিষেক নাটকের অভিনয়ের মাধ্যমে কলকাতার ২৫ নং বিশ্বনাথ মতিলাল লেনের (বহুবাজার) গোবিন্দচন্দ্র সরকারের বাড়িতে এর যাত্রা শুরু হয়। উমাচারণ ঘোষ, অম্বিকা ব্যানার্জী, বিহারীলাল ধর, বলদেব ধর, আশুতোষ চক্রবর্তী প্রমুখ অভিনয়ে অংশগ্রহণ করেন।
পরবর্তী পাঁচ বছর বঙ্গ নাট্যালয়ের কার্যক্রম সম্পর্কে কিছু জানা যায় না। ১৮৭৪ সালে এলাহাবাদের নীলকমল মিত্রসহ কয়েকজন নাট্যামোদী ব্যক্তির প্রচেষ্টায় পুনরায় এর কার্যক্রম শুরু হয় এবং ১৭ জানুয়ারি তাঁরা মনোমোহন বসুর সতী নাটকটি মঞ্চস্থ করেন। একই নাট্যকারের হরিশ্চন্দ্র নাটকটি মঞ্চস্থ হয় ১৮৭৫ সালের জানুয়ারি মাসে এবং এটিই ছিল বঙ্গ নাট্যালয়ের শেষ প্রযোজনা। বঙ্গ নাট্যালয়ই প্রথম বাংলা ভাষায় মুদ্রিত প্রবেশপত্র ব্যবহার করে।
বিদ্যোৎসাহিনী মঞ্চ ১৮৫৭ সালে উত্তর কলকাতার জোড়াসাঁকো সিংহ বাড়িতে কালীপ্রসন্ন সিংহ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি ছিল কালীপ্রসন্ন প্রতিষ্ঠিত বিদ্যোৎসাহিনী সভা নামক একটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের অঙ্গবিশেষ। প্রতিষ্ঠা বছর ১১ এপ্রিল ভট্টনারায়ণের সংস্কৃত নাটক বেণীসংহার-এর রামনারায়ণ তর্করত্নকৃত বঙ্গানুবাদের অভিনয়ের মাধ্যমে বিদ্যোৎসাহিনী রঙ্গমঞ্চের উদ্বোধন হয়। কালীপ্রসন্ন স্বয়ং ‘ভানুমতী’ নামে একটি মহিলা চরিত্রে অভিনয় করেন। সংবাদ প্রভাকর (১৫ এপ্রিল) পত্রিকায় এই অভিনয়ের উচ্চ প্রশংসাসহ সংবাদ পরিবেশিত হয়।
এই রঙ্গমঞ্চে অভিনীত দ্বিতীয় নাটক কালীপ্রসন্ন অনূদিত কালিদাসের বিক্রমোর্বশীয় (২৪ নভেম্বর)। কালীপ্রসন্ন সিংহ, মহেন্দ্রনাথ মুখার্জী, উমেশচন্দ্র ব্যানার্জী (ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম সভাপতি) প্রমুখ প্রখ্যাত ব্যক্তি বিদোৎসাহিনী মঞ্চে অভিনয় করেন।
বেঙ্গল থিয়েটার ১৮৭৩ সালের ১৬ আগস্ট আশুতোষ দেবের দৌহিত্র শরৎচন্দ্র ঘোষ কর্তৃক কলকাতার ৯ নং বিডন স্ট্রিটে প্রতিষ্ঠিত হয়। মিসেস লুইস-এর চৌরঙ্গীর ‘লাইসিয়াম’ থিয়েটারের অনুকরণে শরৎচন্দ্র থিয়েটার বাড়িটি নির্মাণ করেন। নিজস্ব জমির ওপর নির্মিত বাংলা সাধারণ রঙ্গমঞ্চ এটিই প্রথম।
শরৎচন্দ্র এই নাট্যশালাটি যথাযথভাবে পরিচালনার জন্য পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, উমেশচন্দ্র দত্ত প্রমুখ মনীষীর সমন্বয়ে একটি পরামর্শদাতা কমিটি গঠন করেন। প্রতিষ্ঠা দিবসে এখানে মাইকেলের শর্মিষ্ঠা নাটকটি অভিনীত হয়। তারপর সুদীর্ঘ ২৮ বছরের পথপরিক্রমায় বেঙ্গল থিয়েটার ১১০টিরও বেশি নাটক মঞ্চস্থ করে। স্ত্রী-চরিত্রে অভিনয়ের জন্য এই থিয়েটারেই প্রথম জগত্তারিণী, এলোকেশী, গোলাপ (সুকুমারী) এবং শ্যামা নামে চারজন মহিলা অভিনেত্রীকে নিযুক্ত করা হয়।
বেঙ্গল থিয়েটার জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রাজকৃষ্ণ রায়, অমৃতলাল বসু এবং ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদসহ বহু প্রখ্যাত নাট্যকারের পৌরাণিক, ঐতিহাসিক ও সামাজিক নাটক এবং ব্যঙ্গনাট্য, প্রহসন ইত্যাদি মঞ্চস্থ করে। শরৎচন্দ্র ঘোষ, বিহারীলাল চ্যাটার্জী, অমৃতলাল বসু, খগেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী, মহেন্দ্রলাল বসু, এলোকেশী, গোলাপ, শ্যামা, জগত্তারিণী, কুসুম কুমারী এবং আরও অনেক প্রখ্যাত শিল্পীর অভিনয়ে বেঙ্গল থিয়েটার বিপুল খ্যাতি অর্জন করে। বঙ্গ রঙ্গমঞ্চের সম্রাজ্ঞী উপাধিতে ভূষিত অভিনেত্রী বিনোদিনী এই বেঙ্গল থিয়েটারেই তাঁর অভিনয়-জীবন শুরু করেন। ১৯০১ সালের এপ্রিল মাসে ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদের প্রমোদরঞ্জনী নাকটখানির অভিনয়ের পর বেঙ্গল থিয়েটার বন্ধ হয়ে যায়।
বেঙ্গলী থিয়েটার প্রথম বাংলা প্রসেনিয়াম থিয়েটার, ১৭৯৫ খ্রিস্টাব্দে রুশ মনীষী হেরাসিম লেবেদেফ কর্তৃক কলকাতার ২৫ নং ডোমতলায় (বর্তমান এজরা স্ট্রিট) প্রতিষ্ঠিত হয়। লেবেদেফ তাঁর বাংলা ভাষার শিক্ষক গোলকনাথ দাসের সহাতায় এটি নির্মাণ করেন। তিনি দি ডিসগাইজ ও লাভ ইজ দি বেস্ট ডক্টর নামক দুটি ইংরেজি নাটক বাংলায় অনুবাদ করেন। গোলকনাথের প্রস্তাবে দি ডিসগাইজ-এর বাংলা অনুবাদ কাল্পনিক সংবদল মঞ্চস্থ করার ব্যবস্থা হয়। এ ব্যাপারে ক্যালকাটা গেজেট-এর ২৬ নভেম্বর সংখ্যায় প্রকাশিত একটি বিজ্ঞাপন থেকে জানা যায় যে, টিকিট বিক্রির হার ছিল এরূপ: বক্স ও পিট- ৮ টাকা এবং গ্যালারি- ৪ টাকা। পরের দিন ২৭ নভেম্বর নাটকটি মঞ্চস্থ হয়।
বেঙ্গলী থিয়েটারে শেষ নাটক মঞ্চস্থ হয় ১৭৯৬ খ্রিস্টাব্দের ২১ মার্চ। এদিন বিশেষ আসনের মূল্য ছিল এক স্বর্ণমুদ্রা। বেঙ্গলী থিয়েটারে সপ্তাহে মাত্র দুটি প্রদর্শনী হতো। উল্লেখ্য যে, লেবেদেফের বেঙ্গলী থিয়েটারই প্রথম এশীয় ভাষায় প্রসেনিয়াম থিয়েটার-রীতি প্রয়োগ করে।
বেলগাছিয়া থিয়েটার ১৮৫৮ সালে কলকাতার পাইকপাড়ার রাজভ্রাতৃদ্বয় ঈশ্বরচন্দ্র সিংহ ও প্রতাপচন্দ্র সিংহের উদ্যোগে তাঁদের বেলগাছিয়া ভিলায় প্রতিষ্ঠিত হয়। যতীন্দ্রমোহ ঠাকুর, কালীপ্রসন্ন সিংহ, গৌরদাস বসাক ও মাইকেল মধুসূদন দত্ত এই থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। প্রতিষ্ঠা বছর ৩১ জুলাই রামনারায়ণ তর্করত্নকৃত সংস্কৃত নাটক রত্নাবলী-র বঙ্গানুবাদ মঞ্চায়নের মাধ্যমে বেলগাছিয়া থিয়েটারের দ্বারোদ্ঘাটন হয়। ইংরেজ দর্শকদের সুবিধার্থে মধুসূদন ইংরেজিতে নাটকের সারাংশ লিখে দেন।
পরের বছর ৩ সেপ্টেম্বর বেলগাছিয়া থিয়েটারে অভিনীত হয় মধুসূদনের শর্মিষ্ঠা নাটক। প্রিয়নাথ দত্ত, হেমচন্দ্র মুখার্জী, গৌরদাস বসাক, কেশবচন্দ্র গাঙ্গুলী, মহেন্দ্রনাথ গোস্বামী, ঈশ্বরচন্দ্র সিংহ, যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর, রাজেন্দ্রলাল মিত্র প্রমুখ অভিনেতা মুখ্যচরিত্রে অভিনয় করেন। সঙ্গীত পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর। বাংলা থিয়েটারে এই প্রথম ভারতীয় ঐকতান বাদন ব্যবহূত হয়; এতে নেতৃত্ব দেন ক্ষেত্রমোহন গোস্বামী ও যদুনাথ পাল। তৎকালীন সংবাদ প্রভাকর ও হিন্দু পত্রিকায় বেলগাছিয়া থিয়েটারের অভিনয়ের প্রশংসা করা হয়। ১৮৬১ সালের মার্চ মাসে বেলগাছিয়া থিয়েটার বন্ধ হয়ে যায়। [গণেশ মুখোপাধ্যায়]
মহিলা সমিতি মিলনায়তন ঢাকার বেইলী রোডে অবস্থিত। এর মঞ্চটি সাধারণভাবে ‘মহিলা সমিতি মঞ্চ’ নামে পরিচিত এবং স্বাধীনতা-উত্তরকালে এটি ঢাকার নাট্যচর্চায় বিশেষ ভূমিকা পালন করে। গ্রুপ থিয়েটার-চর্চাভিত্তিক নাট্যমঞ্চায়নের মধ্য দিয়ে এর যাত্রা শুরু হয়। এখানে দীর্ঘদিন থেকে বিভিন্ন নাট্যদল নিয়মিতভাবে নাটক মঞ্চস্থ করে আসছে। ঢাকায় নাটকের দর্শক সৃষ্টির ক্ষেত্রে এই মঞ্চে প্রদর্শিত নাট্যসমূহ বিশেষ ভূমিকা রেখেছে, যদিও নাট্যমঞ্চায়নের আধুনিক সুযোগ-সুবিধা এখানে নেই। এ মঞ্চে নাট্যপ্রদর্শনী ব্যতীত অন্য কোন সভা-সমাবেশ কিংবা রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনা হয় না বললেই চলে।
১৯৭৩ সালে এ মঞ্চে প্রথম মঞ্চস্থ হয় বার্নাড শ’ রচিত এবং ড্রামা সার্কল প্রযোজিত দান্তের মৃত্যু নাটকটি। এই দলের পরবর্তী দুটি প্রযোজনা হলো মনোজ মিত্রের সাজানো বাগান (১৯৮০) এবং বিজয় তেন্ডুলকারের চুপ আদালত চলছে (১৯৮৪)। নাগরিক নাট্য সম্প্রদায় ১৯৭৩ সালে মঞ্চস্থ করে বিদগ্ধ রমণীকুল, তৈল সংকট, ক্রস পারপাস ও নিষিদ্ধ পল্লীতে। এভাবে আরণ্যক নাট্যদল, ঢাকা থিয়েটার, নান্দনিক নাট্য সম্প্রদায়, ঢাকা পদাতিক, বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী (নাটক বিভাগ), বিবর্তন সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, লোকনাট্যদল, ঢাকা লিটল থিয়েটার, সড়ক সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংগঠন, লায়ন থিয়েটার প্রভৃতি নাট্যগোষ্ঠী ও সাংস্কৃতিক সংগঠন বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনের নাটক মঞ্চস্থ করেছে।
বাংলাদেশের প্রথম মূকাভিনয় দল ঢাকা প্যান্টোমাইম (১৯৮৯) মহিলা সমিতি মঞ্চে ১৯৯০ সালে প্রদর্শন করে বখাটে ছেলের পরিণতি, বালক ও পাখি, জেলে, প্রেম এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা শীর্ষক মূকাভিনয়। ঢাকাভিত্তিক নাট্যদল ছাড়াও দেশের বিভিন্ন জেলার বেশ কয়েকটি নাট্যদল, একাধিক ভারতীয় নাট্যদল এবং ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইনস্টিটিউট (আই.টি.আই), বাংলাদেশ কেন্দ্র আয়োজিত উৎসবে আগত বিদেশি কয়েকটি নাট্য সংগঠনের নাটকও এই মঞ্চে দর্শনীর বিনিময়ে প্রদর্শিত হয়েছে।
মাহবুব আলী ইনস্টিটিউট ১৯৫০ সালে পুরনো ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয়। পরের বছর শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাসের নাট্যরূপ বিজয়া-র প্রদর্শনী দিয়ে এর যাত্রা শুরু হয়। এখানে বিজন ভট্টাচার্যের নাটক জবানবন্দি মঞ্চস্থ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র-সংসদ। ১৯৫২ সালে মঞ্চস্থ হয় সিকান্দার আবু জাফরের ঐতিহাসিক নাটক সিরাজউদ্দৌলা। ঢাকা মেডিকেল কলেজের ডক্টরস ক্লাব ও কলেজ ছাত্র-সংসদ যথাক্রমে মানময়ী গার্লস স্কুল ও তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের দ্বীপান্তর এবং অগ্রদূত নাট্যসংঘ বিধায়ক ভট্টাচার্যের মাটির ঘর মঞ্চস্থ করে। নাটক মঞ্চায়নের পাশাপাশি এ মঞ্চে অন্যান্য সভা-সমাবেশও অনুষ্ঠিত হয়। [জিল্লুর রহমান জন]
মিনার্ভা থিয়েটার ১৮৯৩ সালে কলকাতার ৬ নং বিডন স্ট্রিটস্থ গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারের জমিতে প্রতিষ্ঠিত হয়। এ বছরেরই ২৮ জানুয়ারি নগেন্দ্রভূষণ মুখার্জীর অর্থানুকূল্যে গিরিশচন্দ্র অনূদিত শেক্সপীয়রের ম্যাকবেথ নাটকের অভিনয়ের মাধ্যমে এর যাত্রা শুরু হয়। তখন থেকে ১৯১২ সাল পর্যন্ত গিরিশচন্দ্র, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রলাল, ক্ষীরোদপ্রসাদ, অমৃতলাল, অমরেন্দ্রনাথসহ অন্যান্য নাট্যকার রচিত প্রায় ৬০খানা নাটক এখানে মঞ্চস্থ হয়। ১৯১৩ সালে উপেন্দ্রনাথ মিত্র কর্তৃক পুনর্গঠিত হয়ে তাঁর ব্যবস্থাপনায় ১৯২২ সাল পর্যন্ত এটি পরিচালিত হয়। এই পর্যায়ে মিনার্ভায় বিভিন্ন ধরনের পঞ্চাশোর্ধ্ব নাটক অভিনীত হয়। ১৯২২ সালের ১৮ অক্টোবর এক বিধ্বংসী অগ্নিকান্ডে মিনার্ভা ভস্মীভূত হয়ে যায়।
১৯২৫ সালে উপেন্দ্রনাথ মিত্রের নেতৃত্বে মিনার্ভা পুনর্নিমিত হয় এবং ৮ আগস্ট মহাতাপচন্দ্র ঘোষের আত্মদর্শন নাটকের অভিনয়ের মাধ্যমে এর দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হয়। নানা প্রকার পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে উপেন্দ্রনাথ ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত মিনার্ভা পরিচালনা করেন। তিনি চলে যাওয়ার পর হেমেন্দ্র মজুমদার, দিলোয়ার হোসেন, চন্ডীচরণ ব্যানার্জী, এল.সি গুপ্ত, রাসবিহারী সরকার প্রমুখ ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত সাধারণ রঙ্গালয় হিসেবে মিনার্ভাকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত করেন।
১৯৫৯ সালে শম্ভু মিত্র মিনার্ভায় নাট্য প্রযোজনা করেন। ঐ বছর জুন মাসে উৎপল দত্ত তাঁর লিটল থিয়েটার গ্রুপ নিয়ে নিয়মিতভাবে পেশাদারি ভিত্তিতে নাট্য প্রযোজনা শুরু করলে মিনার্ভা থিয়েটারের আমূল পরিবর্তন ঘটে। দীর্ঘ এক দশক উৎপল দত্ত অনূদিত ও পরিচালিত শেক্সপীয়রের কয়েকটি নাটকসহ ছায়ানট, নীচের মহল, অঙ্গার, ফেরারী ফৌজ, ভি–আই–পি, তিতাস একটি নদীর নাম, কল্লোল, মানুষের অধিকার প্রভৃতি নাটক সাফল্যের সঙ্গে মঞ্চস্থ হয়। ১৯৬৮ সালে লিটল থিয়েটারের প্রস্থানের পর মিনার্ভায় এক অনিশ্চিত অবস্থার সৃষ্টি হয়; তবে অদ্যাবধি থিয়েটারের ভগ্নপ্রায় বাড়িটি উনিশ শতকের বঙ্গ রঙ্গমঞ্চের এক গৌরবময় অধ্যায়ের সাক্ষ্য বহন করছে।
মেট্রোপলিটন থিয়েটার হিন্দু ‘বিধবা বিবাহ’ প্রথা প্রচলনের উদ্দেশ্যকে বাস্তবায়িত করার মানসে ১৮৫৯ সালে মুরলীধর সেন কর্তৃক কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রখ্যাত বক্তা ও সমাজ-সংস্কারক কেশবচন্দ্র সেন, ধর্মীয় নেতা রেভারেন্ড প্রতাপচন্দ্র মজুমদার, ইন্ডিয়ান মিরর পত্রিকার সম্পাদক নরেন্দ্রনাথ সেন এবং পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এর উদ্যোক্তা ছিলেন। প্রতিষ্ঠা বছরের ২৩ এপ্রিল কলকাতার চিৎপুর সিঁদুরিয়া পট্টির গোপাল মল্লিকের বাড়িতে উমেশচন্দ্র সেনের নাটক বিধবা বিবাহ মঞ্চায়নের মাধ্যমে এটি উদ্বোধিত হয়। বিহারীলাল চ্যাটার্জী, অক্ষয় মজুমদার, মহেন্দ্রনাথ সেন, প্রতাপচন্দ্র মজুমদার, কুঞ্জবিহারী সেন প্রমুখ অভিনয়ে অংশগ্রহণ করেন। অভিনয় পরিচালনা করেন কেশবচন্দ্র সেন এবং দৃশ্যপট অঙ্কন করেন ইউরোপীয় চিত্রশিল্পী মি.হল বাইন। সংবাদ প্রভাকর (১৪ মে) পত্রিকায় এ অভিনয়ের বিবরণ প্রকাশিত হয়। [গণেশ মুখোপাধ্যায়]
রঙমহল থিয়েটার ১৯৩১ সালে কলকাতার কর্নওয়ালিশ স্ট্রিটে (বর্তমান বিধান সরণী) রবীন্দ্রনাথ রায় (রবি রায়) ও সতু সেনের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়। কৃষ্ণচন্দ্র দে (অন্ধ গায়ক) ও রবি রায় পরিচালকের এবং অমর ঘোষ ব্যবস্থাপকের দায়িত্ব পালন করেন। এ ছাড়াও ষষ্টী গাঙ্গুলী, নির্মলচন্দ্র, এস আহমেদ, ডি.এন ধর, হরচন্দ্র ঘোষ, হেমচন্দ্র দে প্রমুখ মিলে রঙমহল থিয়েটারকে একটি যৌথ কোম্পানির চরিত্র দান করেন।
প্রতিষ্ঠা বছরের ৮ আগস্ট যোগেশ চৌধুরীর লেখা শ্রীশ্রীবিষ্ণুপ্রিয়া নাটকটি অভিনয়ের মাধ্যমে রঙমহল থিয়েটারের যাত্রা শুরু হয়। শিশিরকুমার ভাদুড়ী এর পরিচালনা ও অভিনয়ে অংশগ্রহণ করেন। থিয়েটারের দ্বারোদ্ঘাটন করেন আর্ট থিয়েটারের পরিচালক, নাট্যকার ও অভিনেতা অপরেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়।
১৯৩২ সালের ১৭ জানুয়ারি রঙমহল থিয়েটারে মঞ্চস্থ হয় বিজয়িনী নাটক; ২ এপ্রিল বরদাপ্রসন্ন দাশগুপ্তের বনের পাখি এবং ২৫ জুন উৎপলেন্দু সেনের সিন্ধুগৌরব। বনের পাখি নাটকটি বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করে। এই নাটকে অভিনয় করেন রবি রায়, কৃষ্ণচন্দ্র দে, সন্তোষ সিংহ, ধীরাজ ভট্টাচার্য, নির্মলেন্দু লাহিড়ী, চারুবালা, শশীবালা, শেফালিকা, সরযূবালা দেবী প্রমুখ। এঁরা প্রত্যেকেই সেকালের খ্যাতিমান অভিনেতা-অভিনেত্রী ছিলেন। ১৯৩৩ সালের ১৫ এপ্রিল অভিনীত হয় অনুরূপা দেবীর উপন্যাস অবলম্বনে রচিত নাটক মহানিশা। এ নাটকটিও জনপ্রিয় হয় এবং এতেই সতু সেনের প্রচেষ্টা ও কর্মদক্ষতায় প্রথম ঘূর্ণায়মান মঞ্চ ব্যবহূত হয়।
এরপর বহু ভাঙা-গড়ার ভেতর দিয়ে রঙমহল থিয়েটার অগ্রসর হয়। থিয়েটারের মালিকানাও পরিবর্তিত হয় এবং অনেক অভিনেতা-অভিনেত্রীর পরিবর্তন ঘটে। পৌরাণিক, ঐতিহাসিক, সামাজিক ও ব্যঙ্গ্যবিষয়ক নাটক এখানে অভিনীত হয়েছে। কোন কোন নাটক (যেমন উল্কা) একাদিক্রমে ৫০০ রজনী অভিনীত হয়ে বাংলা থিয়েটারে সাড়া জাগিয়েছে। পরবর্তীকালে এই মঞ্চে যাঁরা নাট্য পরিচালনা করেন কিংবা অভিনয়ে অংশগ্রহণ করেন তাঁরা হলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র, মহেন্দ্র গুপ্ত, তরুণ রায় (ধনঞ্জয় বৈরাগী) প্রমুখ। মঞ্চস্থ কয়েকটি প্রধান নাটক হলো: শতবর্ষ আগে, কবি, দুই পুরুষ, মায়ামৃগ, একমুঠো আকাশ, এক পেয়ালা কফি, সাহেব বিবি গোলাম, অনর্থ, চক্র ইত্যাদি। ১৯৭৫ সাল থেকে ক্যাবারে নৃত্য চালু হলে রঙমহলের দীর্ঘকালের ঐতিহ্য বিনষ্ট হয়; রুচিবান অনেক অভিনেতা-অভিনেত্রী রঙমহল ত্যাগ করেন এবং এর ব্যবস্থাপনাও দুর্বল হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় রঙমহল থিয়েটার এখনও টিকে আছে।
লায়ন থিয়েটার ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত। বিশ শতকের প্রথম দিকে মীর্জা আবদুল কাদের ডায়মন্ড জুবিলি থিয়েটার ক্রয় করে এর নতুন নামকরণ করেন লায়ন থিয়েটার। এখানে বাংলা নাটকের পাশাপাশি উর্দু নাটকও মঞ্চস্থ হতো। উর্দু নাটকগুলির মধ্যে ছিল জালমা ও পারাস্তা, বুলবুল এ বিমার ইত্যাদি। ঢাকার নাট্যকার যোগেন গুপ্তের চিড়িয়াখানা এবং বিপিন বিহারী চামের লাঞ্ছনা নামক দুটি প্রহসনও এখানে মঞ্চস্থ হয়। পরবর্তীকালে ঢাকায় ফিল্মের আবির্ভাব হলে লায়ন থিয়েটারে নাটক প্রদর্শন বন্ধ করে ‘লায়ন সিনেমা’ নামে এটিকে প্রেক্ষাগৃহে পরিণত করা হয় এবং চলচ্চিত্র প্রদর্শন শুরু হয়। [জিল্লুর রহমান জন]
স্টার থিয়েটার১ ১৮৮৩ সালে কলকাতার ৬৮ নং বিডন স্ট্রিটে (বর্তমান বিডন স্ট্রিট ও সেন্ট্রাল এভিন্যুর সংযোগস্থল) প্রতিষ্ঠিত হয়। গিরিশ ঘোষ, বিনোদিনী, অমৃতলাল বসু প্রমুখ নাট্যব্যক্তিত্ব এই থিয়েটার প্রতিষ্ঠার উদ্যোক্তা ছিলেন। গুর্মুখ রায় নামে জনৈক অবাঙালি যুবক থিয়েটারে অর্থলগ্নী করেন। তিনি সুন্দরী নটী বিনোদিনীর নামানুসারে ‘বি’ থিয়েটার নামকরণের শর্ত আরোপ করেন; কিন্তু শেষপর্যন্ত ‘স্টার’ থিয়েটার নাম হয়।
প্রতিষ্ঠা বছর ২১ জুলাই গিরিশচন্দ্রের দক্ষযজ্ঞ নাটকের অভিনয়ের মাধ্যমে স্টার থিয়েটারের যাত্রা শুরু হয়। কিন্তু ছয় মাসের মধ্যে গুর্মুখ রায় থিয়েটার বিক্রি করে দিলে অমৃতলাল বসু, দাসু নিয়োগী ও হরি বোস এটি ক্রয় করেন এবং ১৮৮৭ সাল পর্যন্ত সুনামের সঙ্গে পরিচালনা করেন। এরপর স্টার থিয়েটার বন্ধ হয়ে যায়। আর এসব তথ্য সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজন একটি বেস্ট ল্যাপটপ।
স্টার থিয়েটারে মোট ২০খানি নাটক মঞ্চস্থ হয় এবং সেসবের অভিনয়ে অংশগ্রহণ করেন গিরিশচন্দ্র ঘোষ, অমৃতলাল বসু, অমৃত মিত্র, বিনোদিনী, কাদম্বিনী, ক্ষেত্রমণি প্রমুখ খ্যাতনামা শিল্পি। একবার রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব ধর্মীয় নাটক চৈতন্যলীলা দেখতে এসে চৈতন্যের ভূমিকায় বিনোদিনীর অভিনয়ে মুগ্ধ হন এবং তাঁকে আশীর্বাদ করেন। ১৮৮৭ সালের ৩১ জুলাই স্টার থিয়েটারে শেষ অভিনয় অনুষ্ঠিত হয়।
স্টার থিয়েটার২ ১৮৮৮ সালে কলকাতার হাতিবাগানে প্রতিষ্ঠিত হয়। বিডন স্ট্রিটের স্টার থিয়েটার ভেঙ্গে যাওয়ার পর মূলত তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নাট্যকর্মীদের উদ্যোগেই এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ধর্মদাস সুর এবং ইঞ্জিনিয়ার যোগেন গুপ্তের নকশা অনুযায়ী থিয়েটার হাউস ও তার মঞ্চ নির্মিত হয়। এক সময় গিরিশচন্দ্র ঘোষও এর সঙ্গে যুক্ত হন। প্রতিষ্ঠা বছরের ২৫ মে ‘সেবক’ ছদ্মনামে গিরিশ ঘোষ রচিত নসীরাম নাটকের অভিনয়ের মাধ্যমে নবনির্মিত হাতিবাগান স্টার থিয়েটারের উদ্বোধন হয়।
১৯৮৮ সালে স্টার থিয়েটার তার গৌরবের একশ বছর পূর্ণ করে। এই সুদীর্ঘ কালের মধ্যে বহুবার স্টারের মালিকানা পরিবর্তিত হয়। বিভিন্ন সময়ে এর সংস্কার ও আধুনিকীকরণও হয়েছে। শেষদিকে এর মঞ্চটি ছিল ঘূর্ণায়মান। গিরিশচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, অমৃতলাল, দ্বিজেন্দ্রলাল, ক্ষিরোদপ্রসাদ, অপরেশচন্দ্র, মহেন্দ্র গুপ্ত, দেবনারায়ণ গুপ্তসহ ৮০ জনেরও বেশি নাট্যকারের প্রায় ২৫০টি বাংলা নাটক এ মঞ্চে অভিনীত হয়েছে। হিন্দি নাটক অভিনীত হয়েছে ১২টিরও বেশি। গিরিশচন্দ্র, অমৃতলাল, গঙ্গামণি, কাদম্বিনী, অমর দত্ত, দানীবাবু, তারাসুন্দরী, কুসুমকুমারী, অপরেশচন্দ্র, শিশিরকুমার, অহীন্দ্র চৌধুরী, নীহারবালা, সরযূবালা, ছবি বিশ্বাস, উত্তমকুমার, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, রবি ঘোষ, প্রেমাংশু বসু, অনুপকুমার প্রমুখ খ্যাতনামা শিল্পী স্টারে অভিনয় করেছেন। দুর্ভাগ্যক্রমে ১৯৯১ সালের ১৬ অক্টোবর এক ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে ঐতিহ্যমন্ডিত এ থিয়েটার হাউসটি ভস্মীভূত হয়ে যায়।
হিন্দু থিয়েটার ১৮৩১ সালে কলকাতার প্রান্তে শুঁড়ো-নারিকেলভাঙ্গায় প্রসন্নকুমার ঠাকুরের বাগানবাড়িতে প্রতিষ্ঠিত হয়। বাঙালি কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হলেও এ মঞ্চে কোন বাংলা নাটক অভিনীত হয় নি। প্রতিষ্ঠা বছর ২৮ ডিসেম্বর শেক্সপীয়রের জুলিয়াস সিজার নাটকের পঞ্চম অঙ্ক এবং ভবভূতির সংস্কৃত নাটক উত্তররামচরিতম্-এর প্রথম অঙ্কের ইংরেজি অনুবাদ অভিনয়ের মাধ্যমে এর দ্বারোদ্ঘাটন হয়। গঙ্গাচরণ সেন, রামচন্দ্র মিত্র, হিন্দু কলেজ ও সংস্কৃত কলেজের ছাত্রবৃন্দ অভিনয়ে অংশগ্রহণ করেন। ১৮৩২ সালের ২৯ মার্চ নাথিং সুপারফ্লুয়াস নামে একখানি ইংরেজি প্রহসন অভিনীত হওয়ার পর হিন্দু থিয়েটার বন্ধ হয়ে যায়, কারণ এটি বাঙালি দর্শকদের আকর্ষণ করতে পারে নি। [গণেশ মুখোপাধ্যায়]